Archive for the ‘বিশ্লেষনী লেখা’ Category

১৯৭৪ সালে সমুদ্রাঞ্চলে অবস্থিত মোট ৬টি ব্লকে হাইড্রোকার্বন অন্বেষণের জন্য মোট ৬টি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং একটি গ্যাস ক্ষেত্র কুতুবদিয়া আবিষ্কৃত হয়। পেট্রোবাংলা বিনামূল্যে গ্যাসক্ষেত্রটি মালিকানা পেলেও মূল ভূখন্ড পর্যন্ত পাইপলাইন নির্র্মাণে সক্ষম না হওয়ায় গত ৩৭ বছরে এ গ্যাস ক্ষেত্র থেকে গ্যাস উৎপদান সম্ভব হয় নি।

***
১৫.৫.৪ ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশ যদি সমুদ্রের ১৭৫ মাইল দূরের গ্যাস ক্ষেত্র পর্যন্ত প্রয়োজনীয় পরিবহণ ব্যবস্থা (পাইপলাইন) স্থাপন করে কেবল তাহলেই পেট্রোবাংলা তার অংশের প্রফিট গ্যাস (২০%) রাখার অধিকার প্রাপ্ত হবে।
কনোকো ফিলিপস ৮০% বাংলাদেশকে গ্যাস কেনার আহবান জানাবে, কিন্তু তা গ্যাস আকারে দেবে, তরলায়িত করে নয়।

সমুদ্র থেকে উপকূল পর্যন্ত পাইপলাইন বসাতে বাংলাদেশের যে খরচ লাগবে তা কনকো ফিলিপসএর প্রাথমিক বিনিয়োগের তিনগুণ বেশি।

***
ব্যয় এত বেশি হবে যার চেয়ে কম ব্যয়ে মিয়ানমার থেকে স্থল পথে গ্যাস আকারে গ্যাস বা বিদেশ থেকে তরলায়িত গ্যাস আমদানি করা যায়। ক্ষমতা আহোরণ হালাল করতে চুক্তি করে পরবর্তী প্রজন্মসমুহকে নিষ্ঠুরভাবে বঞ্চিত করে সাগরের রিজার্ভ খালি করে দেওয়ার অবশ্যকতা কি?

***
তথ্যসূত্র: অধ্যাপক মোঃ নুরুল ইসলাম
ইনস্টিটিউট অব এপ্রোপ্রিয়েট টেকনোলজি,
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়

গত ১৪ই জুন ‘তেল-গ্যাস, খনিজ সম্পদ, বিদ্যুৎ, বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি’র আহ্বানে জ্বালানী মন্ত্রণালয় ঘেরাও কর্মসূচীতে প্রায় ১২’শ-১৪’শ মানুষ ছিলেন, প্রধানত ছিলেন তরুণেরা । জ্বালানী মন্ত্রণালয় ঘেরাও বা এর সামনে অবস্থান কর্মসূচী মূলত একটা বেপরোয়া কর্মসূচী। অনেকগুলো কর্মসূচী পার হয়ে আমরা বাধ্য হয়ে এই কর্মসূচী দিয়েছি। ২০০৯ সালে যখন পুলিশ আমাদেরকে হামলা করে তখন এবং তারও আগে ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় যখন পিএসসি করার প্রক্রিয়া শুরু হয় তখন থেকেই এটা নিয়ে আমরা প্রশ্ন তুলেছি যে পিএসসি ২০০৮ এর অধীনে যদি বাংলাদেশে চুক্তি হয় তাহলে বর্তমান প্রজন্ম তো বটেই ভবিষ্যৎ প্রজন্মও আমাদেরকে অভিশাপ দেবে। কেননা তারা যে মাত্রায় বঞ্চিত হবে তা ভয় পাইয়ে দেবার মত। একটু দায়িত্বশীল হলেই এটা বোঝা সম্ভব। সেজন্য আমরা সুনির্দিষ্টভাবেই দাবী তুলেছিলাম। এরপর সেটা নিয়ে মাঠে আন্দোলন হয়েছে, লেখালেখি হয়েছে, টেলিভিশনেও কথা বলেছি, এমনকি জ্বালানী বিষয়ক সংসদীয় কমিটির কাছে সুনির্দিষ্টভাবে প্রস্তাবও দিয়েছি। ‘খনিজ সম্পদ নিষদ্ধকরণ আইন’ বিল পাশ করতে পরামর্শ দিয়েছি, এমনকি অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি গোলাম মোহাম্মদ রাব্বানীসহ আরো কয়েকজন আইনজীবী মিলে বিলের খসড়াটি আমরাই করে দিয়েছি। সেই বিল পড়ে আছে প্রায় দুবছর হল। কোন কাজ হয়নি। সরকার কোনরকম ভ্রুক্ষেপ না করে যা খুশি তা করেই যাচ্ছে। কিছুদিন আগে উইকিলিকসের মাধ্যমে প্রকাশিত হল- জেমস মারিয়ার্টি জ্বালানী মন্ত্রনালয়ে গিয়ে জ্বালানী উপদেষ্টা তৌফিক-ই-এলাহীকে বলছেন যে “কনোকো ফিলিপসের সাথে চুক্তি করেন, ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত খনি করেন, শেভরনের কাছ থেকে কমপ্রেশার মেশিল কেনেন” ইত্যাদি। এই বিষয়গুলো সরাসরি মার্কিন দূতাবাস বলছে। আমরা অনেকদিন থেকেই বলে আসছি জ্বালানী মন্ত্রনালয় আর বাংলাদেশের নিজের নাই, এটা বহুজাতিক কোম্পানীর একটা বর্ধিতাংশে পরিণত হয়েছে। উইকিলিকসের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে আসলেই সেটা ঠিক। এরই মধ্যে সরকার কনকো-ফিলিপসের সাথে চুক্তি করে ফেলার তোড়জোড় শুরু করে। যার প্রেক্ষিতে আমরা ১৪ জুন ঘেরাও কর্মসূচি দিতে বাধ্য হই। ১৪ জুনের আরেকটা তাৎপর্য আছে। যেটার জন্য দায়ী জ্বালানী মন্ত্রণালয়, জ্বালানী মন্ত্রণালয়ের অবহেলা। ১৯৯৭ সালের ১৪ জুন মাগুরাছড়ায় ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছিল। অক্সিডেন্টাল নামক একটা মার্কিন কোম্পানী তখন দায়িত্বে ছিল। পরবর্তীতে তদন্ত প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে যে শুধুমাত্র তাদের দায়িত্বে অবহেলার জন্য এই ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছে। সেই তদন্ত প্রতিবেদনে স্পষ্ট বলা হয়েছে এই বিস্ফোরণে ২৫০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস নষ্ট হয়েছে। পরিবেশ, রেললাইন, চা বাগান, এগুলোতো আছেই। ১৯৯৭ থেকে ২০১১, এই সময়েও কিন্তু এই ক্ষতিপূরণ আদায় করা হয়নি। জ্বালানী মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের ব্যয় বহন করেন জনগণ, তারা বেতন পান, বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা পান; সেটা কি জন্য? জনগণের স্বার্থ দেখার জন্য, জ্বালানী নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য। কিছুদিন আগে ‘বিপি আমেরিকা’ গালফ অব মেক্সিকো- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপকূলীয় অঞ্চলে তেল অনুসন্ধান করতে গিয়ে একটা দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে। মিডিয়ার মাধ্যমে সেই দুর্ঘটনার ভয়াবহতা, ফলাফল আমরা দেখেছি। বিপি আমেরিকার নির্বাহী কর্মকর্তাদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের যে জ্বালানী বিষয়ক কমিটি এবং কংগ্রেসের বিভিন্ন ধরণের বডি দুই মাসের মধ্যে অন্তত দশবার তাদের ডেকে শুনানি করেছে পাবলিকলি, যা সরাসরি সম্প্রচার হয়েছে টিভি চ্যানেলে। অথচ আমাদের দেশে ১৯৯৭ থেকে ২০১১ পর্যন্ত জ্বালানী বিষয়ক সংসদীয় কমিটি কখনোই এটা নিয়ে কোন শুনানী করতে পারে নি। লোক দেখানোর জন্য আনুষ্ঠানিকতাও করতে পারত, তাও করে নি। বরঞ্চ একবার ডেইলি স্টার পত্রিকায় একটা ঘটনা প্রকাশিত হয়েছিল। ঘটনা টা এরকম- এখন যিনি জ্বলানী উপদেষ্টা তখন তিনি জ্বালানী সচিব ছিলেন, সেই সময় জ্বালানী বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সভাপতি ছিলেন আওয়ামীলীগের জাঁদরেল একজন লোক আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ। তিনি জ্বালানী সচিবকে বলেছিলেন “এরকম একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে, পিএসসি নিয়ে এত সমালোচনা, রপ্তানী বিষয়ে বিরোধীতা হচ্ছে, আমি ঐ চুক্তির কপিটা দেখতে চাই”। জ্বালানী সচিব তাকে বলেছেন “এই চুক্তি আপনাদেরকে দেখানো যাবে না”। তাহলে ভেবে দেখুন, আমাদের সংসদ, আমাদের নির্বাচিত প্রতিষ্ঠান, আমাদের সংসদীয় কমিটি, তাদের চুক্তির ব্যাপারে কোন এখতিয়ার নাই। কে তাহলে নির্ধারণ করে বাংলাদেশের সম্পদের ভবিষ্যৎ? জ্বালানী সচিব কিন্তু শেষ পর্যন্ত ও সেটা দেখান নাই। অক্সিডেন্টাল যে দুর্ঘটনাটা ঘটিয়েছে বাংলাদেশে, সেই ঘটনা ঘটানোর পর লভ্যাংশ নিয়ে তারা নিজেরা দরদাম করে ইউনোক্যালের কাছে তাদের ব্যাবসাটা বিক্রি করে দিয়ে চলে গেল। পেট্রোবাংলার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল এই কেনাবেচা বিষয়ে, তারা বলেছে তারা কিছু জানে না। ইউনোক্যালও ব্যাবসা করলো কিছুদিন, তারপর তারা সেই ব্যাবসা শেভরনের কাছে বিক্রি করে দিল। এখন সেটা শেভরনের কাছে আছে। সুতরাং দায়দায়িত্ব এখন শেভরনের। তারমানে বাংলাদেশের জিনিস এই যে তারা কেচাবেচা করল এর উপর বাংলাদেশের কিন্তু কোন কন্ট্রোল নাই। ভয়ংকর ব্যাপার এই যে এখনো পর্যন্ত এই চুক্তিগুলো গোপন। আন্তর্জাতিক ভাবে চুক্তি রিভাইসের বিধান আছে, সরকার চাইলে সেটা করতে পারে। অথচ আমাদের দেশে হচ্ছে উল্টোটা। রিভাইস হচ্ছে, কিন্তু সেটা কোম্পানীর স্বার্থে। যেমন কিছুদিন আগে, সান্টোস নামক একটা অস্ট্রেলীয় প্রতিষ্ঠানকে অনুমুতি দেয়া হল তারা আমাদের গ্যাস ইচ্ছামত দামে বিক্রি করতে পারবে যেকোন পক্ষের কাছে। সরকারের কাছে বিক্রি করতে তারা বাধ্য থাকবে না, নির্দিষ্ট দামের বাধ্যবাধকতা থাকবে না, এটা আগের পিএসসিতে ছিল না, তারা রিভাইস করেছে। রিভিশনগুলো হচ্ছে এইরকম আত্নঘাতী ধরণের। আমরা গ্যাস সংকটে ভুগছি, আমাদের বিদ্যুৎ নাই, অথচ শেভরনের কাছে ২৫০ বিসিএস গ্যাস এবং নাইকোর কাছে আরো ২৫০ বিসিএস গ্যাস মোট ৫০০ বিসিএস গ্যাস নষ্ট হয়েছে, অথচ সেটা আমরা পাচ্ছি না। এই পরমাণ গ্যাস যদি আমরা আন্তর্জাতিক বাজার থেকে সংগ্রহ করতে চাই, গড় দাম যদি ধরি ১০ ডলার তাহলে দাম দাঁড়ায় ৫ বিলিয়ন ডলার অর্থ্যাৎ ৩৬-৩৭ হাজার কোটি টাকা। এই বছর বাজেটে জ্বালানী খাতে বরাদ্দ আট হাজার কোটি টাকা। তারমানে প্রায় চার বছরের বাজেটেরও বেশি টাকা আমরা এই কোম্পানীর কাছেই পাই। এই টাকা আদায় তো করা হচ্ছেই না বরং তাদেরকে আরো নতুন নতুন জায়গা দেয়া হচ্ছে। লাউয়াছড়ার মত বনাঞ্চল তাদের হাতে দেয়া হচ্ছে, সুন্দরবনে তাদের প্রবেশাধিকার দেয়া হচ্ছে। এরমকম ঘটনাগুলোই যখন আমরা দেখছি সেই সময়েই কনকো- ফিলিপসের সাথে চুক্তিটি করা হল। যেকারণে আমরা ১৪ জুন ঘেরাও কর্মসূচী দিতে বাধ্য হয়েছিলাম। আমাদের দাবীর মধ্যে কিন্তু এটাও ছিল যে শেভরনের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণের টাকা আদায় করতে হবে। সরকার সবসময় বলে আমাদের পুঁজির অভাব। পুঁজির অভাব বলে যে সমস্ত কোম্পানীকে আনা হয়েছে তাদের কারণেই যত টাকা পুঁজির অভাব বলা হয়েছিল তার দশ গুণ টাকা আমাদেরকে ভর্তুকি দিতে হয়। কারণ বিদেশী কোম্পানীর কাছ থেকে আমাদেরকে বেশি দামে কিনতে হয়। তার মধ্যে রিভাইস করে যখন তাকে অধিকার দেয়া হচ্ছে আরো বেশি দামে গ্যাস বিক্রির তখন কিন্তু ভর্তুকির পরিমাণটা আরো বাড়ে। এই ভর্তুকির ফলাফলে বাজেটের উপর চাপ পড়ে, অর্থমন্ত্রী তখন বলেন ভর্তুকি কমাতে হবে, ভর্তুকি কমানোর জন্য গ্যাসের দাম বাড়ে, বিদ্যুতের দাম বাড়ে, সেই প্রভাব চাল-ডাল-আলুসহ সবকিছুর উপর পড়ে। অনেকে ভাবেন গ্যাস-তেল-কয়লা এগুলোর সাথে তার নিজের জীবনের কোন সম্পর্ক নাই। কিন্তু প্রতিদিন তার পকেট থেকে যে বাড়তি টাকা কাটা যাচ্ছে, প্রতিদিন যে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে সেটার সাথে এইধরণের চুক্তির সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। সেকারণে এটা শুধু গ্যাস বা কয়লা রক্ষার ব্যাপার না। আমাদের সমগ্র অর্থনীতি যে একটা ভয়ংকর বিপর্যয়ের দিকে যাচ্ছে সেটা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এই জন্য এই ইস্যু গুলোকে আমরা সামনের দিকে আনছি। কনোকো ফিলিপসের সাথে এই চুক্তি আমাদেরকে আরো ভয়াবহ একটা অবস্থার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। কারণটা হল এটা সমুদ্রের মধ্যে। আমরা কিন্তু এখনো জানিনা আমাদের বঙ্গোপোসাগরে কি বিশাল সম্পদ আছে। সমুদ্রে এখনো অনেক অজানা সম্পদ আছে। বিবিসিতে একবার একটা আলোচনা শুনলাম, সেখানে আন্তর্জাতিক জ্বালানী বিশেষজ্ঞরা আলোচনা করছেন “তেলের ভবিষ্যত কি” এই বিষয় টা নিয়ে? একজন বিশেষজ্ঞ বলছিলেন, তেলের ভবিষ্যত নিয়ে তেমন সংকটের সম্ভাবনা নাই। সামনে কিছু ভাল মজুদ আছে, একটা আলাস্কা, আরেকটা ‘বে অব বেঙ্গল’। অর্থ্যাৎ বঙ্গোপসাগর তাদের সাংঘাতিক মনোযোগের মধ্যে আছে। এই কথাটা শুনে আমার আনন্দিত হওয়ার কথা ছিল, আমি কিন্তু আনন্দিত হতে পারি নাই। আমার কাছে মনে হল এই যে সম্পদের খবরগুলো আসছে এগুলোর সম্ভাবনা বাড়া মানে হল আমাদের বিপদ বাড়া। যাদের দায়িত্ব এগুলোকে জনগণের স্বার্থে কাজে লাগানোর, সেই জায়গাটাতেই বড় ধরণের সমস্যা। সমস্যাটা এমন যে সম্পদ বেশি হওয়া মানেই আমাদের বিপদ বৃদ্ধি পাওয়া। এবং সেটারই লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। গ্যাস অনুসন্ধানই হোক, আর সীমানা নির্ধারণই হোক, মায়ানমার, ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, এইসমস্ত রাষ্ট্রের যে তৎপরতা বঙ্গোপসাগর নিয়ে এবং সেইসাথে আমাদের সরকারগুলোর যে ভূমিকা দেখতে পাচ্ছি তাতে আমাদের ভবিষ্যত খুবই বিপদাপন্ন। বঙ্গোপসাগরে বিশাল সম্পদ আছে সেটাকে ২৮ টি ব্লকে ভাগ করা হয়েছে তার মধ্যে দুটি ব্লক কনোকো ফিলিপসকে দেয়া হচ্ছে। সেই দুটো ব্লকে যে কাঠামোতে চুক্তি করা হচ্ছে সেটা হচ্ছে পিএসসি ২০০৮(প্রোডাকশন শেয়ারিং কন্ট্রাক্ট-২০০৮) এর অধীনে। মালিকানা কাদের থাকবে, উত্তোলিত গ্যাসের শেয়ার, বা গ্যাস ছাড়া অন্য কোন সম্পদ যদি পাওয়া যায় সেটার মালিকানার ধরণটা কি হবে, সেটার কস্ট টা কিভাবে ডিস্ট্রিবিউশন হবে, মুনাফা কিভাবে ডিস্ট্রিবিউশন হবে, উঠানোর পরে গ্যাসটা কোথায় বিক্রি করা হবে, রপ্তানীর বিধান থাকবে কিনা সেগুলো এই পিএসসির মধ্যে আছে। কিছু কিছু জিনিস অস্বচ্ছ- যেমন গ্যাস ছাড়া অন্য কোন সম্পদ থাকলে সেইসব বিষয়ে অস্বচ্ছতা আছে। পরিষ্কারভাবে যেটা আছে, যেটা বাংলাদেশের জন্য বিপদ সেটা হল, কস্ট রিকভারী এবং প্রফিট শেয়ারিং হওয়ার পরে বাংলাদেশ তার অংশ পাবে। তবে কোনভাবেই বাংলাদেশ ২০% এর বেশি গ্যাস পাবে না। এবং সেই গ্যাসটা স্থলভাগে আনতে হলে বাংলাদেশের নিজের অবকাঠামো তৈরী করে আনতে হবে। স্থলভাগের অবকাঠামো নির্মাণ খরচ আর সমুদ্র থেকে স্থলভাগ পর্যন্ত অবকাঠামো নির্মাণ খরচ তো একই বিষয় নয়। এই অবকাঠামো বলতে পাইপ লাইন তৈরী করতে হবে গ্যাস আনার জন্য যা একটা বিশাল ব্যয়সাধ্য ব্যাপার। আর ৮০% গ্যাস তারা পেট্রোবাংলাকে অফার করবে কেনার জন্য। পেট্রোবাংলা না কিনলে সেটা এলএনজি(তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) করে বিদেশী রপ্তানী করবে এই বিধান রয়েছে পিএসসি ২০০৮ এ। বাংলাদেশ যদি দেখে ২০% গ্যাস আনার খরচ পুরো গ্যাসের দামের চাইতে অনেক বেশি তখন বাংলাদেশ হয়ত সেটা আনবে না। তখন পুরো গ্যাসের মালিকানা পাবে কনোকো ফিলিপস। সবমিলিয়ে রপ্তানীর একটা অত্যন্ত অনুকূল একটা পরিবেশ এই বিধানে রাখা হয়েছে। ইউনিভার্সিটি অব হিউস্টন কিছুদিন আগে একটা গবেষণা করে তা প্রকাশ করেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে গ্যাসের চাহিদা, সেই চাহিদা পূরণের জন্য কোন জায়গা থেকে এবং কিভাবে গ্যাস আনলে সেটা ইকোনমিক হবে। এই জরিপটা করা হয়েছে এলএনজি করে বিদেশ থেকে গ্যাস আমদানী করা কতটা যুক্তিসঙ্গত তার উপর। এই জরিপের জন্য অর্থায়ন করেছে যে কোম্পানী তার নাম কনকো ফিলিপস। স্টাডি রিপোর্টে বলা হচ্ছে যে আর ১৫ বছরের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গ্যাসের যে ঘাটতি তার পরিমাণ হবে ৪ থেকে ৭ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। এবং সেটা দূর থেকে যদি এলএনজির মাধ্যমে আনা হয় সেটাই হবে সবচেয়ে কস্ট ইফেকটিভ। কনোকো ফিলিপস যে দুইটি ব্লকে অনুসন্ধান কাজ শুরু করতে যাচ্ছে ধারণা করা হচ্ছে সেখানে কমপক্ষে প্রায় চার টিসিএস গ্যাস থাকবে। মজুদের ব্যাপারটা আমরা বুঝতে পারি বিভিন্ন অঞ্চলে স্যাটেলাইট ইমেজিং এর মাধ্যমে একটা প্রাথমিক ধারণা করে। এরপর সুনির্দিষ্ট করার জন্য অনুসন্ধান করা হয়। এখন ঐ দুইটা ব্লকে গ্যাস আছেই এটা প্রাথমিকভাবে মোটামুটিভাবে নিশ্চিত কিন্তু কোন পয়েন্টে গ্যাস আছে সেটা নিশ্চিত না। একটা জায়গায় অনুসন্ধান করলেই গ্যাস পাওয়া যাবে তা নয়। কয়েকটা জায়গায় অনুসন্ধান করলে একটা জায়গায় পাওয়া যেতে পারে। বলা হচ্ছে যে মার্কীন কোম্পানীটি একটি বিপুল পরিমান অর্থ বিনিয়োগ করবে, ফলে তার অংশ একটু বেশি হওয়াই স্বাভাবিক। এটা আসলে কস্ট নিয়ে তৈরী করা এক ধরণের মিথ । মিথটা এরকম যে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে বিপুল টাকা লাগে। কিন্তু বাস্তব অবস্থা তা নয়। কনোকো ফিলিপস প্রাথমিক যে অনুসন্ধান করবে তার বাজেটটা তাদের ওয়েবসাইটে দেয়া। এর পরিমাণ- পাঁচ বছরের জন্য ১১০ মিলিয়ন ডলার অর্থ্যাৎ বাংলাদেশী টাকায় ৭৭০ কোটি টাকা। গড়ে বছরে ২০০ কোটি টাকারও কম। বাংলাদেশের জন্য এই টাকা কোন টাকাই না। । সবচেয়ে বড় কথা, পৃথিবীতে এই ধরণের কাজ করার একক সক্ষমতা আছে এমন কোন প্রতিষ্ঠান আদতে নাই। বিপি আমেরিকার ব্যাপারটা দেখলে তা স্পষ্ট হয়। দুর্ঘটনার পর অনুসন্ধানে দেখা গেছে কোন কাজ বিপি আমেরিকা নিজে করেনি, সবই বিভিন্ন কোম্পানীকে সাব-কন্ট্রাক্ট দিয়েছে। বাংলাদেশেই সাঙ্গুর পাশে ড্রিলিং এর জন্য সান্তোস চুক্তিবদ্ধ হয়েছে নরওয়ের একটা ড্রিলিং কোম্পানীর সাথে। আমরাও সেরকম নিজেদের মালিকানায় সাব-কন্ট্রাক্ট দিতে পারতাম। চুক্তিটা হওয়ার ফলে প্রকৃতপক্ষে কনোকো ফিলিপসের আন্তর্জাতিকভাবে একটা গুরুত্ব তৈরী হবে কারণ বঙ্গোপসাগর সে পাচ্ছে। তার শেয়ারের মূল্য বেড়ে যাবে, সে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নেবে, বিভিন্ন ফান্ডিং এজেন্সি তার সাথে আসবে এবং পরবর্তীতে সে বিভিন্ন কোম্পানীকে সাব-কন্ট্রাক্টে এসব কাজ দিয়ে দেবে। আমরা জাতীয় মালিকানার কথা বলি তার মানে এই না যে সব কাজ নিজেরা করা। এটা কোন দেশ পারেনা। এমন কোন দেশ নাই যারা শতভাগ কাজ নিজেরা করতে পারে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল মালিকানা। দুটো বিষয়কে আমরা সাংঘাতিক গুরুত্বপূর্ণ মনে করি, প্রথমটি হচ্ছে জাতীয় মালিকানা, যেহেতু এই সম্পদ সীমিত ও অনবায়নযোগ্য সেহেতু তা নিজেদের হাতে রাখা। দ্বিতীয়ত, জাতীয় মালিকানায় থাকলে আমরা প্রয়োজন অনুযায়ী সাব-কন্ট্রাক্ট দিতে পারব এবং আমাদের প্রয়োজন অনুযায়ী উত্তোলন করতে পারব। আর বহুজাতিক কোম্পানী কি করবে? সে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা ইনভেস্ট করবে, যতদ্রুত সম্ভব গ্যাস উত্তোলন করে মার্কেটাইজ করে প্রফিট রিয়ালাইজ করবে। আর আমাদের জন্য দরকার বিদ্যুতায়ন ও শিল্পায়নের জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী উত্তোলন ও ব্যবহার। মালিকানা যদি আমাদের হাতে থাকে তাহলে আমরা বিদেশী কোম্পানী বা বিদেশী এক্সপার্ট ভাড়া করে আমাদের প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত করে অনুসন্ধান করতে পারি, উত্তোলন করতে পারি। তাহলে গ্যাস সম্পদটাও আমাদের হাতে থাকল সেই সাথে বিশেষজ্ঞও তৈরী হতে থাকল। আমরা তখন আন্তর্জাতিক ভাবেও প্রতিযোগীতা করতে পারব। এখন কনোকো ফিলিপস যেখানে অনুসন্ধান করবে সেখানে গ্যাস ছাড়া অন্য কিছু পাওয়া গেল কিনা সেটা মনিটরিং কে করবে? স্বাধীনতার ৪০ বছর পর প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কিংবা অনেক ভূতত্ত্ববিদ যখন বলেন আমাদের দেশে এক্সপার্ট নাই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে আমি তখন লজ্জা বোধ করি, ভাবি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করি কি আমরা অদক্ষতা তৈরীর জন্য নাকি দক্ষ জনশক্তি তৈরীর জন্য? তাহলে আমরা শিক্ষকতা করছি কেন? আমরা আগে ভাবতাম আমরা অনসোরে এক্সট্রাকশনই করতে পারি না, কিন্তু এখন তা করছি, রিগ কেনা হয়েছে। ১৯৭৪ সালে পেট্রোবাংলা প্রতিষ্ঠিত হয়, এটা ছিল একটা গুরুত্বপুর্ণ সিদ্ধান্ত। জ্বালানী উপদেষ্টা, বিভিন্ন কনসালটেন্ট, বিভিন্ন বিদেশী কোম্পানী যারা এখন বলছে আমাদের সক্ষমতা নাই, এই দৃষ্টিভঙ্গি যদি ১৯৭৪ সালে থাকত তাহলে কি হত? কারণ তখনতো আসলেই কিছু ছিল না। কিন্তু পেট্রোবাংলা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল জাতীয় দায়িত্ববোধ থেকে। এবং এটা প্রতিষ্ঠার কারণে আশি দশকে আমাদের একটা অবকাঠামো, একটা ভিত্তি তৈরী হয়েছে, বেশ কিছু জনশক্তি তৈরী হয়েছে। তৈরী হওয়ার ফলে ১৯৯৮ সালে বিদেশী কোম্পানী আসার আগে পর্যন্ত শতভাগ গ্যাস কিন্তু জাতীয় প্রতিষ্ঠানই উত্তোলন করেছে। এখনো করতে পারে যদি তাদেরকে সেই সুযোগটা দেয়া হয়। দেয়া হয়নি। দক্ষতা এবং সক্ষমতা প্রথমেই আসে সিদ্ধান্ত থেকে। প্রথম দফা ৯৩-৯৪ সালে বিএনপির সময়ে, পরবর্তীতে ৯৭-৯৮ সালে দ্বিতীয় দফা বিডিং এর মাধ্যমে স্থলভাগেরই অনেকগুলো ব্লক বিদেশী কোম্পানীকে দিয়ে দেয়া হয়। যার ফলে প্রতিবছর আমাদেরকে দুই থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে, গ্যাসের দাম বাড়ছে, বিদ্যুতের দাম বাড়ছে। এই সমস্যাগুলো নিয়ে আমরা প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলতেও চেয়েছি কিন্তু তার সুযোগ কখনো হয়নি। প্রধানমন্ত্রী বরাবরে আমরা আমাদের সমস্ত কাগজপত্র, সমস্ত বক্তব্য পাঠিয়েছিলাম। প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানী বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সাথে আমরা খোলামেলা বিস্তারিত আলোচনা করেছি। বিষয়টা তো এমন নয় যে আমরা গোঁয়ার্তুমি করতে চাই, সেটা নিঃসন্দেহে অপ্রয়োজনীয়। অনেকেই বলেন- এক্সপার্টরা কিছু বলছেন না, আপনারা কেন এত কথা বলছেন। আমিতো দেখি যারা কোন কোম্পানীর সাথে যুক্ত নন বা বিদেশী কোম্পানীর কনসালটেন্সি করেন না তারা ছাড়া প্রত্যেকে পিএসসি ২০০৮ বা রপ্তানীমুখী চুক্তি, কিংবা উন্মুক্ত কয়লা খনির বিরোধিতা করেন। সেই বিশেষজ্ঞদের কথা যদি সরকার শোনে তাহলে সম্পুর্ন চিত্রটা কিন্তু অন্যরকম হয়। এবং কয়েকদিন আগে বুয়েটের প্রবীণ শিক্ষক ড. নুরুল ইসলাম যিনি এই পিএসসির বিরোধীতা করে আসছেন তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন । তার উদ্বেগ প্রকাশের পর পত্রিকায় দেখলাম অর্থমন্ত্রী বিষয়টা সমন্ধে জানতে চেয়েছেন। কিন্তু জিনিসটা কিন্তু মন্ত্রী পরিষদ হয়েই গেছে। এমন হতে পারে কেউ দেখছেন না যে কি জিনিস যাচ্ছে। হতে পারে এর পেছনের শক্তি এত বড় যে মন্ত্রীও দেখছেন না তিনি কি ফাইলে সাইন করছেন। প্রধানমন্ত্রী কতটা জেনেশুনে এটা করছেন আমরা জানিনা। সংসদীয় কমিটিই যেমন আমাদেরকে বলেছে যে তারা রপ্তানী করবেন না কারণ আমাদের অভ্যন্তরীন প্রয়োজন রয়েছে। আমরা বলেছি- ধরে নিলাম আপনারা ভাল মানুষ আপনারা রপ্তানী করবেন না, কিন্তু আপনারা তো চিরদিন ক্ষমতায় থাকবেন না। আপনি চুক্তির মধ্যে রপ্তানীর সুযোগ রাখছেন অতএব সে যদি বেটার অপশন পায় সে তো রপ্তানী করবেই। এবং অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখে এসেছি যে জ্বালানী মন্ত্রণালয় বহুজাতিক কোম্পানী যেভাবে চায় সেভাবেই কাজ করে। সেক্ষেত্রে আপনারা যদি আসলেই মনে করেন যে রপ্তানী করবেন না তাহলে রপ্তানীর বিধানটাকেই বাদ দিয়ে দিচ্ছেন না কেন। অথবা ‘খনিজ সম্পদ নিষিদ্ধকরণ আইন’ এর বিল আমরাই তৈরী করে দিচ্ছি, সেটা পাশ করান। তাহলে পরে খারাপ লোকেরা আসলেও রপ্তানী করতে পারবে না। তাহলে এক ধরণের আস্থা তৈরী হয় যে হা আসলেই আপনার রপ্তানী করবেন না। দুই বছর হল সেটা পড়ে আছে, সেটা নিয়ে কোন আলোচনা হয় নাই, কোন সিদ্ধান্ত হয় নাই। কিছু সংখক লোক যারা এই চুক্তি করে সুবিধা পাচ্ছে, কমিশন পাচ্ছে কিংবা কনসালটেন্সি ফী পাচ্ছে তারা বাদ দিয়ে আওয়ামীলীগের সমর্থক হোক আর বিএনপির সমর্থক হোক যদি বিদ্যুতের দাম বাড়ে, গ্যাসের দাম বাড়ে, যদি শিল্পায়ন না হয়, বাংলাদেশের সমস্ত ক্ষেত্রে যদি ভর্তুকির চাপ বাড়ে, অন্যান্য সব ক্ষেত্র- শিক্ষা-চিকিৎসা সব বিপর্যস্ত হয় তাহলে প্রত্যেকটা মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হবে। সেজন্য আমরা মনে করি এটা একটা জাতীয় আন্দোলন। ১৪ তারিখের ঘেরাওয়েও আমি অনেক প্রবীণ মানুষ দেখেছি যাদেরকে আমি চিনি না। তারা নিজেদের আগ্রহ থেকে এসেছেন। অনেকের চিঠি, ফেসবুক বা ইমেইলের মাধ্যমে পাঠানো বার্তা সবকিছু থেকে আমি অনুভব করি যে এই আন্দোলনের প্রতি একটা জনসমর্থন আছে। এমনকি আওয়ামীলীগ বা বিএনপিরও অনেক মানুষ আছে যারা এটাকে সমর্থণ করেন। এর একটা ‘জাতীয়’ ধরণ আছে। যারা এটা অনুভব করেন তারা এসেছেন। রেহনুমা আহমেদ হচ্ছেন তাদের মধ্যে একজন অগ্রণী মানুষ এবং বিশেষজ্ঞ। অনেক তরুণ নারী পুরুষ ছিলেন সেখানে। সেইরকম একটা আন্দোলন যেটা পরিষ্কার একটা জাতীয় স্বার্থের বিষয় সেখানে সরকারের এই বাধা পরিষ্কার একটা মেসেজ দিতে চাচ্ছে যে কনোকো ফিলিপস বা বিদেশী কোম্পানী অনেক বেশি গুরুত্বপুর্ণ। এই কোম্পানীর সম্মান তার রক্ষা করতে হবে, তার সাথে চুক্তি করতে হবে। ফুলবাড়ীতে একজন কৃষক ক্ষুব্ধ হয়ে একবার বলেছিলেন, ভোট কি আমরা দেই নাকি কোম্পানী দেয়? ভোটতো আমরা দেই তাহলে সরকার আমাদের কথা কেন শুনবে না? সেই কৃষক যে প্রশ্নটি উত্থাপন করেছে সেটা আমারো প্রশ্ন, এটা একটা মৌলিক প্রশ্ন। কারণ জনগণ আপনাকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছে, কনোকো ফিলিপস তো ভোট দেয়নি। শেখ হাসিনা বলেছিলেন যে গ্যাস রপ্তানীর বিষয়ে মুচলেকা দিয়ে আগের সরকার সরকার ক্ষমতায় গিয়েছিল। এই ব্যাপারে শেখ হাসিনার সাথে আমি একমত। এটা হওয়া খুবই সম্ভব। ক্ষমতায় যাওয়ার দুইদিন পর তৎকালীন অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন যে যদি মাছ-চা-চামড়া রপ্তানী করতে পারি তাহলে গ্যাস রপ্তানী করতে সমস্যা কি? বোঝাই যায় যে তাদের একটা কমিটমেন্ট ছিল। এখন যখন এই সরকার আগের সরকার বিষয়ে এই কথা বলছে আমি কিন্তু সেটা বিশ্বাস করছি যে হ্যা এটা হওয়া খুবই সম্ভব। এবং তারপর যখন এই সরকার একই কাজ করতে যাচ্ছে তখন কি আমার মনে প্রশ্ন আসবে না যে তাহলে কি এই সরকারও মুচলেকা দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে। এই চুক্তির মধ্য দিয়ে যে ভয়াবহতার মধ্যে আমরা প্রবেশ করতে যাচ্ছি তা হল, পুরো বঙ্গোপসাগর অঞ্চল যার আয়তন বাংলাদেশের প্রায় দ্বিগুন। ভারত একটা অংশ দাবী করছে, মায়ানমার একটা অংশ দাবী করছে। ভারতের অংশে অনুসন্ধান করবে না কনোকো ফিলিপস। তারমানে ভারত একটা অংশ নিয়ে যাবে, মায়ানমার একটা অংশ নেবে, আর যে অংশটুকু বিরোধহীন ভাবে বাংলাদেশের সেটুকু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে যাবে। তাহলে আমাদের জন্য কি থাকবে? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সারা দুনিয়াতে যা করছে তাতে কিছুদিন পরেই তারা বলবে আমার দেশের কোম্পানী এখানে আছে, তাদের নিরাপত্তার জন্য এখানে মার্কিন নেভি থাকতে হবে। সব মিলিয়ে আমরা শুধু যে গ্যাস বা খনিজ সম্পদ হারাবো তাই নয়, আমরা আমাদের জাতীয় নিরাপত্তাকেই হুমকির দিকে ঠেলে দিচ্ছি। এর আগে যখন আমাদের মিছিলের উপর হামলা করা হয়েছিল তখন বিএনপি এই হামলার নিন্দা জানিয়েছিল, আমাকে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলেন। সমর্থনের প্রশ্নটি যখন এসেছে, সাংবাদিকরা যখন জানতে চেয়েছে বিএনপি সমর্থন দিলে আমরা নেব কিনা, তখন আমি পরিষ্কার বলেছি যেকোন দল যদি আমাদেরকে সমর্থন দেয় আমরা নেব। কিন্তু, বিএনপি নিজের আমলে এধরণের চুক্তি করেছে, সুতরাং বিএনপি কে পাবলিকলি বলতে হবে যে তারা চুক্তি করে ভুল করেছে, জাতীয় স্বার্থবিরোধী কাজ করেছে এবং ভবিষ্যতে এধরনের চুক্তি করবে না। এটা যদি পরিষ্কারভাবে পাবলিকলি বলে তাহলে আমাদের কোন সমস্যা নাই। কারণ আমরা তো একটা নির্দিষ্ট দাবী, নির্দিষ্ট ইস্যুকে ধরে অগ্রসর হচ্ছি। সেই ইস্যুতে পরিষ্কার যারা থাকবে তাদের সাথেই আমাদের ঐক্য হতে পারে। এখন আওয়ামীলীগে অনেকেই আছেন, মন্ত্রী হিসেবেও আছেন, পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানও আছেন তারাতো জাতীয় কমিটির সাথে ছিলেন, কাজ করেছেন। এবং নির্দিষ্ট ইস্যুর ভিত্তিতেই কাজ করেছেন। তাদের কমিটমেন্ট থেকে তারা সরে গিয়েছেন, আমরা তো সেই কমিটমেন্ট নিয়েই কাজ করছি। বঙ্গোপসাগরের মত এত বড় একটা জিনিস, এখানকার সম্পদ বিদেশীদের হাতে দিয়ে দেয়া হচ্ছে। আমরা স্পষ্টভাবে বলতে চাই যে সরকার এক্ষেত্রে নেতিবাচক ভূমিকা নিচ্ছে। তারা কনোকো ফিলিপস বা মার্কিনদের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করছে। এখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আছে, ভারত আছে, অর্থ্যাৎ বিভিন্ন দেশ যুক্ত হয়ে আছে এবং তাদের সহযোগী হিসেবে সরকার তাদের ইন্টারেস্ট নিয়ে কাজ করছে। জাতীয় কমিটি রাষ্ট্র ক্ষমতা নিয়ে ক্ষমতার লড়াই করছে না- এটা জাতীয় কমিটির এজেন্ডার মধ্যে নাই। আমরা মনে করি যে কাজ আমরা করছি সেটা কোন দলীয় বিষয় নয়, এটা জাতীয় স্বার্থ, জাতীয় সার্বভৌমত্বের লড়াই। এখন এই অবস্থায় আমাদের ভরসা শুধুমাত্র একদিকে তথ্য-যুক্তি, আরেকদিকে জনগণের শক্তি।

সম্পাদনাঃ আতিয়া ফেরদৌসী চৈতী

গত ১৬ জুন সমুদ্র বক্ষের ১০ এবং ১১ নম্বর ব্লকে গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য কনকো-ফিলিপস এর সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। শুরু থেকেই দেশের প্রগতিশীল বামপন্থী শক্তি এই ধরনের যে কোনো চুক্তির বিরোধীতা করে আসছে। তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা কারণে এই ধরনের চুক্তির বিরোধীতা করেছে তার যুক্তিগুলো হচ্ছে-

*১৫.৫.৪ ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশ যদি সমুদ্রের ১৭৫ মাইল দূরের গ্যাস ক্ষেত্র পর্যন্ত প্রয়োজনীয় পরিবহণ ব্যবস্থা (পাইপলাইন) স্থাপন করে কেবল তাহলেই পেট্রোবাংলা তার অংশের প্রফিট গ্যাস রাখার অধিকার প্রাপ্ত হবে, তবে তা কোনো মতেই মোট প্রাপ্ত গ্যাসের ২০% এর বেশি হবে না।
উল্লেখ্য যে, সমুদ্র থেকে উককূল পর্যন্ত পাইপলাইন বসাতে বাংলাদেশের যে খরচ লাগবে তা কনকো-ফিলিপস-এর প্রাথমিক বিনিয়োগের তিনগুণ বেশি। আরো উল্লেখ্য যে, অনভিজ্ঞ দুর্নীতিপরায়ণ আমলা ও রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে যোগসাজসে প্রোডাকশন বা উত্তোলন ব্যয় প্রকৃত ব্যয়ের তুলনায় ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে এত ষ্ফীত করা যায় যে, প্রফিট ভাগাভাগির আগেই রিজার্ভ প্রায় শূন্য হয়ে যায়। ফলে অবশিষ্ট অংশের বৃহদাংশ দিলেও প্রাপ্ত গ্যাস রিজার্ভের অমর্যাদাকর সীমা ২০% পর্যন্তও না পৌঁছার সম্ভাবনাই বেশি। অতীতে সাঙ্গু গ্যাসফিল্ডের অভিজ্ঞতা এই সম্ভাবনা নির্দেশ করে।

* ১৫.৫.১, ১৫.৫.৪, ১৫.৫.৫, ১৫.৬ ধারায় বর্ণিত শর্তসাপেক্ষে কন্ট্রাক্টর ১৫.৫.২ ধারায় বর্ণিত হিসাব অনুসারে কন্ট্রাক্টর চুক্তিকৃত এলাকায় উৎপাদিত যেকোনো পরিমাণ মার্কেটেবল গ্যাস এলএনজি হিসাবে বাংলাদেশের অংশসহ রফতানির অধিকার পাবে।

* কনোকো ফিলিপস বাংলাদেশকে গ্যাস কেনার আহ্বান জানাবে ঠিক, কিন্তু তা গ্যাস আকারে দেবে, তরলায়িত করে নয়। গভীর সমুদ্রে ১৭৫ মাইল দুর থেকে পাইপ লাইনে গ্যাস পরিবহনের জন্য পাইপের নীচে কিছুদুর অন্তর ঝড় সুনামি মোকাবেলায় সক্ষম স্টিলের যে সাপোর্ট লাগবে তার জন্য ব্যয় এত বেশি হবে যার চেয়ে কম ব্যয়ে মিয়ানমার থেকে স্থল পথে গ্যাস আকারে গ্যাস বা বিদেশ থেকে তরলায়িত গ্যাস আমদানি করা যায়। অতএব বিনা যুদ্ধে শান্তিপূর্ণ চুক্তি করে পরবর্তী প্রজন্মসমুহকে নিষ্ঠুরভাবে বঞ্চিত করে সাগরের রিজার্ভ খালি করে দেওয়ার অবশ্যকতা কি?

* বলা হয়েছে কুপ থেকে মেজারিং পয়েন্ট কনোকো ফিলিপস পরিবহন করে দেবে। মেজারিং পয়েন্ট এর অবস্থান নির্দিষ্ট করা হয়নি। যদি তা কূপের কাছে হয় তবে কনোকো ফিলিপস এর লাভ হবে। যদি চট্টগ্রাম তা কক্সবাজারের কাছে হয় তবে আমাদের সুবিধা। অতীত যদি কোন নির্দেশক উদাহরণ হয় তবে বলাই যায়, সামান্য অবৈধ সুবিধার বিনিময়ে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা মন্ত্রী-উপদেষ্টা অবশ্যই কন্ট্রাকটর, কনোকো ফিলিপস এর স্বার্থে মেজারিং পয়েন্টকে উৎপাদন কূপের কাছে রাখাও আপত্তি করবে না।

* কনকো-ফিলিপস দুর্ঘটনার রাজা হিসাবে কুখ্যাত। তাদেরকে কন্ট্রাকটর হিসাবে নিয়োগ বঙ্গোপসাগরকে এক ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে ফেলল। মাগুড়ছড়া ও টেংরাটিলার অভিজ্ঞতা থেকে আমরা নিশ্চিত যে, বিশাল ধ্বংযজ্ঞ ঘটালেও তার ক্ষতিপূরণ আমরা পাবো না। পিএসসি ২০০৮ এর ১০.২৭ ধারাতে রহবভভরপরবহু বা অদক্ষতার জন্য বিপর্যয়ের দরুন ক্ষতিপূরণ আদায়ের যে বিধান ছিল তা সংশোধন করে কন্ট্রাকটরকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।
* এই চুক্তির মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে ভারত ও মায়ানমারের দাবি মেনে নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের অংশ তুলে দেয়া হয়েছে মার্কিন কোম্পানির হাতে।

কোনো দেশপ্রেমিক মানুষই সরকারের এই ধরনের পদক্ষেপকে সমর্থন জানাতে পারে না। তাই আসুন বুক বেধে নামি জাতীয় সম্পদ রক্ষার লড়াইয়ে।

‘আমরা আগে গাছ গুনে রাখতাম। নিসর্গ প্রজেক্ট শুরু হওয়ার আগে আমাদের হিসাবে লাউয়াছড়ায় সেগুনগাছ ছিল ৩০ হাজার। এখন ৩০০ আছে কি না সন্দেহ।’ ক্ষোভের সঙ্গে কালের কণ্ঠকে বলেন, মো. হাতিম আলী। ধর্মান্তরিত মুসলমান হাতিম আলী লাউয়াছড়ার খাসিয়াপল্লীতে বাস করছেন ৪৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে।
পাকিস্তান আমলে ১৯৬৫ সালের দিকে বন রক্ষার জন্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আনা হয় আদিবাসী মানুষ। সেই থেকে বনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এসব মানুষ। নিসর্গ প্রজেক্ট হওয়ার আগে এখানকার আদিবাসী মারমা, ত্রিপুরা, খাসিয়ারাই পাহারা দিত বন। হিসাব রাখত বনের গাছের। কিন্তু নিসর্গ প্রজেক্ট হওয়ার পর তারাই বনের অঘোষিত মালিক হয়ে বসে। নিসর্গ ও আইপ্যাকের অন্যতম লক্ষ্য ছিল বনের উন্নয়ন, অথচ তাদের আমলেই কমতে থাকে গাছ, পশুপাখি ও জীবজন্তুর সংখ্যা। খাসিয়াপঞ্জি থেকে গভীর অরণ্যের মধ্য দিয়ে হেঁটে তিন কিলোমিটারের পথ আমতলা হয়ে লাউয়াছড়ার প্রধান সড়ক। যেতে এক ঘণ্টার বেশি লাগবে। তিন কিলোমিটার বনের মধ্যে মাত্র ১১টি সেগুনগাছের সন্ধান পাওয়া গেছে। তবে পথে পথে চোখ এড়ায় না সেগুনগাছের অসংখ্য কাটা গুঁড়ি। হাতিম আলী মনে করেন, যদি লাউয়াছড়ার বন বাঁচাতেই চাইত নিসর্গ, তাহলে আদিবাসীদের নিয়ে টহলদল তৈরি করত। তিনি বলেন, ‘লাউয়াছড়ার ভবিষ্যৎ খুব খারাপ। এই বন ধ্বংস হয়ে যাবে। কারণ এ বনের মধ্যে অনেক গ্যাস পাওয়া গেছে। শেভরন গ্যাস নিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বনও ধ্বংস করে দিয়ে যাবে।’
খাসিয়াপঞ্জির অধিবাসীদের দাবি, শেভরনের সিসমিক জরিপের পর থেকে জুম চাষে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। ওই জরিপের পর থেকে পানের পাতায় পর্চা রোগ বেড়েছে। এই রোগ হলে পানের পাতায় বসন্তের মতো গুটি গুটি দাগ ওঠে। তবে এসব ব্যাপারে পরিবেশবাদী সংগঠন বেলা বা আইইউসিএনের কোনো নজর নেই। বিশ্বব্যাপী শেভরনের পার্টনার হিসেবে কাজ করে থাকে আইইউসিএন ও ইন্টারন্যাশনাল রিসার্চ গ্রুপ (আইআরজি)। আইআরজি আবার একই সঙ্গে মার্কিন সংস্থা ইউএসএইডেরও কনসালট্যান্ট প্রতিষ্ঠান। আইইউসিএন ২০০৬ সালে পরামর্শ ফি বাবদ শেভরনের কাছ থেকে চার কোটি ৬২ লাখ ৮৬ হাজার ৮৭৫ ডলার গ্রহণ করে। অন্য এক তথ্যে দেখা গেছে, ২০০৭ সালের নিসর্গ প্রজেক্টের বাজেটের ১৭ শতাংশ পরামর্শক মার্কিন প্রতিষ্ঠান আইআরজিকে দিতে হয়, যার পরিমাণ ১৯ লাখ ছয় হাজার ৮২৫ ডলার। এর একটি অংশ আবার বাংলাদেশের পরিবেশবাদী সংগঠন বেলাকে দেওয়া হয়েছে আইন পরিবর্তনের পরামর্শক হিসেবে। অভিযোগ রয়েছে, অর্থ পাওয়ার কারণেই লাউয়াছড়ার ক্ষতি নিয়ে কথা বলে না পরিবেশবাদী সংগঠন বেলা ও আইইউসিএনের মতো সংগঠনগুলো।
বনের খুব কাছে শেভরন বর্তমানে চারটি পয়েন্টে ড্রিল করছে। এর প্রভাবে বনের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। বনের সামগ্রিক অবস্থা সম্পর্কে কো-ম্যানেজমেন্ট কমিটির উপদেষ্টা এবং বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. মাহবুবুর রহমানকে এ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়। জবাবে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ক্ষয়ক্ষতির আগাম সম্ভাবনা এনভায়রনমেন্টাল ইম্পেক্ট অ্যাসেসমেন্ট রিপোর্টের মাধ্যমে করা হয়। জ্বালানি মন্ত্রণালয় এটা করেছে বোধ হয়। তারা এ ব্যাপারে বলতে পারবে। আমি এ রিপোর্টটি পাইনি। এনভায়রনমেন্টাল ইম্পেক্ট অ্যাসেসমেন্ট রিপোর্ট ছাড়া অগ্রিম এ ব্যাপারে বলা সম্ভব নয়।’
সংরক্ষিত বন লাউয়াছড়ার মধ্য দিয়ে নেওয়া হয়েছে গ্যাসের পাইপলাইন। এই পাইপলাইন দিয়ে শেভরন জাতছড়া বাগানের গ্যাস জাতীয় পাইপলাইনে যাবে। পাইপলাইনে কোনো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলে পুরো বন ধ্বংস হয়ে যাবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। সংরক্ষিত বনের মধ্য দিয়ে পাইপলাইন নির্মাণে অনেকে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।
এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মনিরুল খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গ্যাসকূপ সংরক্ষিত এলাকায় বা এর কাছাকাছিও থাকার কথা নয়। লাউয়াছড়ার ভেতর দিয়ে যে গ্যাসের পাইপলাইন গেছে, এটা খুবই বিপজ্জনক। কখনো যদি কোনো কারণে আগুন লেগে যায় তবে পুরো বনাঞ্চল ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।’ তবে এসব নিয়ে চিন্তা নেই বেলা, আইইউসিএনসহ দেশের পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর।
যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অর্থায়নে সাড়ে ছয় মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাজেট নিয়ে আরণ্যক ফাউন্ডেশন থেকে ২০০৫ সালের জুন মাসে যাত্রা শুরু হয় নিসর্গ সাপোর্ট নামের একটি পাইলট প্রজেক্টের। লাউয়াছড়া ছাড়াও এ প্রজেক্টের আওতায় রয়েছে সাতছড়ি সংরক্ষিত বন (হবিগঞ্জ), টেকনাফ গেম রিজার্ভ (কঙ্বাজার), চুনতি বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য (চট্টগ্রাম) এবং রেমাকালেঙ্গা বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য (হবিগঞ্জ)। নিসর্গের অর্থের জোগানদাতা ইউএসএইড। আর ইউএসএইডকে বার্ষিক মোটা টাকা দেয় শেভরনসহ তেল-গ্যাস উত্তোলনকারী অন্য মার্কিন বহুজাতিক কম্পানিগুলো।
নিসর্গ প্রজেক্টে বাংলাদেশের তিনটি এনজিওকে সাব-কনট্রাক্ট দিয়েছে প্রজেক্টের পরামর্শক যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান আইআরজি। এই তিন এনজিওর মধ্যে রয়েছে কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট সেন্টার অব চিটাগাং (কোডেক), ন্যাচার কনজারবেশন অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট (ন্যাকম) ও রংপুর-দিনাজপুর রুরাল সার্ভিস (আরডিআরএস)। তবে আইন পরিবর্তনের জন্য আইআরজি বাংলাদেশের দুটি প্রতিষ্ঠানকে সাব-কনট্রাক্ট দিয়েছে। এই দুটি প্রতিষ্ঠান হলো বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) ও দ্য ওয়াইল্ডলাইফ ট্রাস্ট বাংলাদেশ। এর মধ্যে বেলা নিসর্গ প্রজেক্টে অন্তর্ভুক্ত হয় ২০০৭ সালে। ২০০৮ সালে নিসর্গ প্রজেক্টের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়, শুরু হয় ইন্টিগ্রেটেড প্রটেক্টেড এরিয়া কো-ম্যানেজমেন্ট প্রজেক্ট (আইপ্যাক)। আইপ্যাক কাজ করবে ২০১৩ সাল পর্যন্ত। তবে আইপ্যাক সূত্রে জানা গেছে, বেলার কাজ ছিল ১৯৭৪ সালের সংশোধিত বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ) আইনটিকে শেভরনের স্বার্থে পরিবর্তন করে দেওয়া। চুক্তি মোতাবেক আইন পরিবর্তনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করে দেওয়ার পর প্রজেক্টে বেলার আর কোনো কাজ নেই। বর্তমানে আইনটি বন বিভাগে রয়েছে সরকারের কাছে উপস্থাপনের জন্য।
নিসর্গ ও আইপ্যাকের মূল লক্ষ্য ছিল ইকোট্যুরিজম নিশ্চিত করা। ইকোট্যুরিজম না হওয়ায় বনের পরিবেশ দিন দিন ধ্বংসের মুখে। এ সম্পর্কে আইপ্যাকের ক্লাস্টার ডিরেক্টর মলয় কে সরকার কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রথম থেকেই ইকোট্যুরিজম লক্ষ্য থাকলেও এখন পর্যন্ত তা সম্ভব হয়নি। তিনি আরো বলেন, ‘এখনো মাইক, ভুভুজেলা বাজিয়ে বনের পরিবেশ নষ্ট করছে পর্যটকেরা, যাতে বনের অভয়াশ্রম ও প্রজনন মারাত্মকভাবে নষ্ট হচ্ছে। এই প্রজেক্টের এটা বড় ব্যর্থতা।’
আইপ্যাক থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, ২০০৯-এর ১ নভেম্বর থেকে ২০১১ সালের মে মাস পর্যন্ত লাউয়াছড়া বনে এক লাখ ৬৬ হাজার ৯৪২ জন পর্যটক ভ্রমণ করেছেন। অধিকসংখ্যক পর্যটক বনে প্রবেশের কারণে বনের পশুপাখির প্রজনন ব্যবস্থা ভয়াবহ হুমকির মুখে পড়েছে।
যে আইপ্যাক বন ধ্বংস থেকে বাঁচানোর জন্য তৈরি করা হয়েছে, তাদের বিষয়টি নিয়ে কোনো উদ্বেগ নেই। উল্টো অধিকসংখ্যক পর্যটক বন ভ্রমণ করায় ৩৬ লাখ ৯ হাজার টাকা রাজস্ব আদায়কেই তারা সাফল্যের সঙ্গে দেখছে।
স্থানীয় জীবজন্তু প্রেমিক ও পরিবেশকর্মী সিতেশ রঞ্জন দেব কালের কণ্ঠকে বলেন, এই বনে কিভাবে প্রবেশ করতে হয় তা পর্যটকেরা জানেন না। ফলে এখানে যে কেউ প্রবেশ করছে, যা বনের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। তিনি আরো বলেন, ‘এই শেভরন লাউয়াছড়া চায় না, তারা চায় দ্রুত গ্যাস তুলে এলাকা থেকে সরে পড়তে। এ কারণে তারা এনজিও থেকে শুরু করে বিশেষজ্ঞদের অর্থ দেয়। বেলা, আইইউসিএনের মতো এনজিওগুলো ক্যাশ টাকা নিয়ে চলে, তারা কিছু বলবে না।

আরিফুজ্জামান তুহিন ও বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন।
মূল লিংকঃ http://www.kalerkantho.com/?view=details&type=gold&data=Natok&pub_no=579&cat_id=1&menu_id=13&news_type_id=1&news_id=170779&archiev=yes&arch_date=12-07-2011

কেউ কেউ ধারনা করেন যে গ্যাস ক্ষেত্রে বিদেশী কোম্পানিকে গ্যাস আবিষ্কার ও উত্তোলনের জন্য প্রদান করা, বর্গাদার কর্তৃক বর্গাচাষীকে জমি ভাড়া দেয়ার মতোই অনুরুপ একটি বিষয়। কয়েকটি কারণে এই তুলনাটি এক্ষেত্রে একটু সাবধানে আমাদের গ্রহণ করতে হবে। কারণগুলি নিম্নরূপ-

ক. প্রথমত, এই বিশেষ ক্ষেত্রে বর্গাদার হচ্ছে খুবই দুর্বল এবং গরীব এবং বর্গাচাষী হচ্ছে প্রবল প্রতাপান্বিত এক শক্তি। গ্যাসক্ষেত্রের উৎপাদন-বন্টন চুক্তিকে ’’সহজ পাঠের’’ খাতিরে যদি আমরা বর্গার সঙ্গে তুলনাও করি মনে রাখতে হবে তা হচ্ছে অর্থনীতির ভাষায় একটি বিপরীত বর্গার (Inverse Sharecropping) দৃষ্টান্ত। এখানে গ্যাসক্ষেত্রটি বর্গা দিচ্ছে তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশ বাংলাদেশ এবং বর্গা নিচ্ছেন প্রবল প্রতাপান্বিত বহুজাতিক কোম্পানি কনকো ফিলিপস। এখানে ক্ষমতার অসমতা এবং অপ্রতিসম তথ্যের (Information Asymmetry) প্রতিকলতা বিদ্যমান।

খ. দ্বিতীয়ত, গ্যাসক্ষেত্রের ইজারায় ইজারাদারের ঝুঁকির পরিমাণ বেশি হওয়াই স্বাভাবিক বলে মনে হয়। কারণ এমন হতে পারে যে পুরো অভিযান চালানোর পর কোন গ্যাসই পাওয়া গেল না। অথবা যতটুকু গ্যাস পাওয়া গেল তা বাণিজ্যিক উত্তোলনের জন্য উপযোগী নয় (অর্থাৎ তুলতে যা খরচ বিক্রি করে তত দাম নাও পাওয়া যেতে পারে )। তখন ইজারাদারের পুরো Investment মাঠে মারা যাবে। আমাদের অবশ্য তখন কোনো ক্ষতিও নাই, লাভও নাই। আর গ্যাস আবিষ্কৃত হলে Investment-টি লাভজনক হবে কি না তার সবটাই আবার নির্ভর করবে খরচ কত হচ্ছে এবং কী দামে কতটুকু গ্যাস বিক্রি হচ্ছে তার ওপর। আবিষ্কৃত গ্যাসে ইজারাদারের শেয়ার কতটুকু থাকছে সেটাও গুরুত্বপুর্ণ নির্ধারক বিষয়। তবে যদি গ্যাসক্ষেত্রের মালিকের গ্যাস প্রাপ্তির সম্ভাবনা সম্পর্কে সঠিক তথ্য জ্ঞান না থাকে, পক্ষান্তরে ইজারাদার কোম্পানিটি যদি নিশ্চিত তথ্যের অধিকারী হয় তাহলে এই তথ্য অপ্রতিসমতার কারণে ইজারাদার ইজারামালিককে নানা মিথ্যা ঝুঁকির কথা বলে নিজের জন্য অনেক বেশি শেয়ার দাবি করতে পারেন। একইভাবে বেশি দামে বিক্রির স্বাধীনতাও চাইতে পারেন। সাধারণ বর্গায় বা ইজারায় এধরনের সমস্যা নেই।

গ) বর্গা যেমন নগদ সন জমায় হতে পারে আবার অর্ধেক-অর্ধেক বা তেভাগা চুক্তিতেও হতে পারে। কিন্তু উৎপাদন-বন্টন চুক্তিতে প্রথমে ইজারাদারকে তার খরচ মিটিয়ে দিতে হয়, পরবর্তীতে প্রফিট-গ্যাসের শেয়ার ভাগাভাগি করে নিতে হয়। এক্ষেত্রে ইজারাদার খরচ বেশি দেখিয়ে আবিষ্কৃত গ্যাসের প্রায় পুরোটাই নিয়ে নিতে পারেন। তখন প্রফিট-গ্যাস অবশিষ্ট থাকবে সামান্য এবং তার বড় অংশ ইজারা মালিক পেলেও সামগ্রিকভাবে তার অংশ সামান্যই থেকে যাবে! তদুপরি কষ্ট-রিকভারির জন্য শেয়ার কতটুকু হবে বা প্রফিট গ্যাসের শেয়ারই বা কতটুকু হবে তা মূলত নির্ভর করবে ইজারাদার ও ইজারাপ্রদানকারীর পারস্পরিক দর কষাকষির ক্ষমতার ওপর। যদি ইজারাদার শক্তিশালী হয় তাহলে সে মোট গ্যাসের সিংহভাগের অধিকারী হবে এবং ইজারামালিককে হয়তো মোট গ্যাসের বা মোট বিক্রয়লব্ধ অর্থের নগণ্য অংশ পেয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। তখন তার অংশ মোট গ্যাসের তিন ভাগের এক ভাগও নাও হতে পারে। নগদ টাকায় বা বিক্রয়লব্ধ অর্থের ভাগ-ভাটোয়ারার ভিত্তিতে যদি চুক্তি হয় তাহলে আরেকটি খুবই সংবেদনশীল প্রশ্ন  এসে যাবে তা হচ্ছে গ্যাস কোথায়, কার কাছে এবং কি দামে বিক্রি করা হবে-তার ওপরই নির্ভর করবে মোট প্রাপ্ত অর্থ এবং সেটার থেকে কে কতটুকু নিবেন সেটা নির্ভর করবে ভাগ-বাটোয়ারার পূর্বনির্ধারিত সুনির্দিষ্ট চুক্তির উপর এবং আবিষ্কৃত উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের পরিমানের উপর। এক্ষেত্রে বিক্রেতা সর্বদাই চাইবেন সর্বেচ্চ পরিমাণে এবং সর্বোচ্চ দামে গ্যাস বিক্রি করতে কারন তাতে তার পুঁজি ও মুনাফা সবচেয়ে দ্রুত উঠে আসবে।

এই সতর্কতাসূচক উপপাদ্যগুলি মনে রেখে আমরা যদি মডেল পিএসসি ২০০৮ চুক্তিটির ব্যবচ্ছেদ করি তাহলে আমাদের সম্ভাব্য বাসত্মব অবস্থাটা কি দাঁড়াচ্ছে?

বাস্তব সম্ভাব্য অবস্থা ?

আমাদের আলোচ্য চুক্তিতে ভাগাভাগির ধরনটিই এমন যে মোট গ্যাসের ৫৫ শতাংশ বিদেশী বিনিয়োগকারীকে দিতে হবে তার ‘‘কষ্ট রিকভারি’’ গ্যাস হিসাবে। বাকি যে ৪৫% গ্যাস থাকবে সেটাই বিভিন্ন অনুপাতে কনকোফিলিপ ও আমাদের মধ্যে ভাগাভাগি হবে। এই অনুপাতগুলি হচ্ছে দরকষাকষির বিষয় এবং তা চুড়ামত্ম করা হয় ফাইনাল চুক্তি স্বাক্ষরের মুহূর্তে। সেটা এখনো পর্য়মত্ম চুক্তির গোপনীয়তার কথা বলে জনগণকে জানানো হয়নি! একটি সাধারণ অনুমান হচ্ছে যে তা অর্ধেক-অর্ধেক ভাগ হবে। তাহলে কিন্তু আমরা সবমিলিয়ে পাবো মোট গ্যাসের মাত্র ২২.৫০% আর কনকোফিলিপ পাবে ৭৭.৫০%। ’’সহজ পাঠের’’ লেখক অবশ্য (দেখুন ম তামিম, ’’গ্যাস উৎপাদন অংশীদারি চুক্তির সহজ পাঠ’’-দৈনিক প্রথম আলো, ২২ শে ফে: ২০১১) দাবী করেছেন যে গভীর সমুদ্রের গ্যাসের ক্ষেত্রে এই অংশটি প্রতিদিনের উৎপাদন মাত্রা অনুযায়ী নিধারিত হবে এবং তার সর্বোচ্চ পরিমাণটি প্রফিট গ্যাসের ৭৫ শতাংশ এবং সর্বনিম্ন পরিমাণটি ৫০ শতাংশ পর্যমত্ম হতে পারে। অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে এই চুক্তির মাধ্যমে মোট গ্যাসের (কষ্ট রিকভারি গ্যাস+ প্রফিট গ্যাস ) সর্বনিম্ন ২২.৫০ শতাংশ এবং সর্বোচ্চ ৩৩.৭৫ শতাংশ গ্যাস বাংলাদেশ) পেতে পারে। পক্ষান্তরে Cost recovery এবং নিজস্ব প্রফিট হিসাবে কনোকো ফিলিপস সর্বোচ্চ ৭৭.৫০ শতাংশ থেকে ৬৬.২৫ শতাংশ পাবে। এখানে আমরা অবশ্য ধরে নিয়েছি ৫৫% গ্যাসের দ্বারা কষ্ট রিকভারি কমপ্লিট হয়ে যাবে। যদি তা না হয় তাহলে আমাদের গ্যাসের শেয়ার এরপরেও আরো কমবে। আর যদি আরো কম গ্যাসেই কষ্ট-রিকভারি হয়ে যায় (অর্থাৎ পেট্রোবাংলা যদি সর্বোচ্চ দেশপ্রেম নিয়ে কষ্ট মনিটর করে) তাহলে হযতো শেয়ার বাড়বে। কিন্তু তামিম সাহেব যদি রপ্তানির সুযোগ সংক্রান্ত ধারাবলিও এখানে পাশাপাশি তুলে ধরতেন তাহলে পূর্ণাঙ্গ সত্য প্রকাশ পেত। তখন দেখা যেত ভাগ-বাটোয়ারার পূর্বনির্ধারিত সম্ভাব্য অনুপাতটি হচ্ছে ৮০.২০।

এ কথা ধরে নেয়া যেতে পারে যে বঙ্গোপসাগরের যে ব্লগগুলি জরীপের জন্য ইজারা দেয়া হয়েছে সেগুলিতে গ্যাস বা তেল প্রাপ্তির শতকরা পঞ্চাশভাগের বেশি সম্ভাবনা না থাকলে এতগুলি কোম্পানি (৬-৮টি) এই ইজারায় অংশগ্রহণ করতেন না। লাভের উজ্জ্বল সম্ভাবনা আছে বলেই তারা এসেছেন। অতএব গ্যাস অথবা তেল হয়তো পাওয়া যাবে! আমাদের দিক থেকে সবচেয়ে ভালো হোত যদি উপযুক্ত তথ্যভিত্তিক জ্ঞানের ভিত্তিতে বাংলাদেশ সরকার স্বয়ং বা পিপিপি’র অধীনে বেসরকারি-সরকারি খাত মিলে এই জরিপের কাজটা আমরা নিজেরাই সম্পন্ন করতে পারতাম। সে জন্য যেটুকু অর্থ ও প্রযুক্তি লাগতো তা নিজেরাই যদি সংগ্রহ করতে পারতাম তাহলে তা সম্ভব হতো এবং সেই চেষ্টাটাই আমাদের সর্বাগ্রে করতে হতো। তাহলে আবিষ্কৃত পুরো গ্যাসটাই আমাদের ইচ্ছামতো আমরা ব্যবহার করতে পারতাম এবং কাউকেই সেই জন্য কোনো বাড়তি মুনাফা আমাদের দিতে হতো না। জরিপের জন্য প্রাইভেট পার্টনার অথবা ব্যাংকগুলির কনসোর্টিয়ামকে তাদের বিনিয়োগের বা তহবিলের জন্য কিছু মুনাফা এবং সুদ দিতে হলেও সেটা জাতীয় আয় বৃদ্ধিতেই সহায়ক হোত। তাতে আরেকটা বড় লাভ হোত সেটা হচ্ছে পঞ্চাশ বছরের জন্য জ্বালানী রিজার্ভ রাখার যে প্রতিশ্রুতি বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী অতীতে দিয়েছিলেন এবং দিয়ে তার ভাষায় তিনি ২০০১ সালের নির্বাচনে জিততে ব্যর্থ হন সেরকম একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ নীতিকে আমরা অনায়াসেই বাস্তবায়িত করতে পারতাম। যেহেতু পুরো গ্যাসটা প্রথম থেকেই জাতীয় মালিকানায় থাকতো সুতরাং  জ্বালানি নিরাপত্তা ক্ষুন্ন করে কোনো গ্যাস রপ্তানি করা অসম্ভব হতো। এই অর্থে যে রপ্তানির কোনো বাধ্য-বাধকতা আমাদের ওপরে থাকতো না। কারণ দেশীয় বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান বা ব্যাংককে টাকাতেই খরচ/সুদ মুনাফা প্রদান করা যেত। গ্যাস রপ্তানি করে ডলার উপার্জন করে ডলারে তাদের পাওনা মেটানোর প্রয়োজন হতো না। ধরা যাক, এই সর্বোত্তম রাস্তাটি আমরা এখন গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছি কারণ আমাদের যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত নেই, যথেষ্ট প্রযুক্তি নেই বা সংগ্রহ করাও সম্ভব নয় এবং যথেষ্ট বিনিয়োগযোগ্য তহবিল নেই। যদি এগুলি সব সত্যও হয়ে থাকে তার পরেও আমরা ভেবে দেখতে পারতাম যে স্থলভাগের যেসব এলাকা থেকে গ্যাস বর্তমানে উত্তোলিত হচ্ছে এবং যে সব গ্যাসক্ষেত্র জরিপের জন্য নির্ধারিত হয়ে আছে-সেগুলিতে আগে গ্যাস উৎপাদন সর্বোচ্চ করা সম্ভব কি না। যদি দেখা যায় পুরনো গ্যাসক্ষেত্রগুলোর Work over করে এবং সুনেত্রা সহ সদ্য আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে গ্যাস উত্তোলনের ব্যবস্থা করে গ্যাস আরো সস্তাতেও পাওয়া যায় এবং রপ্তানির ঝুঁকিও থাকে না বা বিদেশীদের ডেকে আনতে হয় না তাহলে আপাতত সমুদ্র নিয়ে মাথা ঘামানো স্থগিতও রাখতে পারতাম। ইতোমধ্যে আমাদের জ্ঞান, অর্থনৈতিক ক্ষমতা এবং প্রযুক্তিগত ক্ষমতা আরো বৃদ্ধি পেতো এবং তখন স্বউদ্যোগে আমরা আমাদের সমুদ্রের গ্যাস অনুসন্ধানে তৎপর হতে পারতাম। এটা অবশ্য নির্ভর করবে ‘গ্যাস চাহিদা’ কতখানি তীব্র ও Critical  স্তরে রয়েছে তার ওপর। এ কথা ঠিক যে বর্তমান যা গ্যাস চাহিদা তার ৭৫ শতাংশের বেশি গ্যাস এখন দেশের ভেতরে উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে না এবং কাতার থেকে তিন-চার গুণ দাম দিয়ে আমরা LNG গ্যাস আমদানির কথা ভাবতে শুরু করেছি। এ কথাও কেউ বলতে পারেন যে ভারত ও মায়ানমার যেহেতু সমুদ্রবক্ষে গ্যাস অনুসন্ধান শুরূ করে দিয়েছে, সুতরাং আর দেরি করা চলে না। ধরা যাক এই শেষ দুটি যুক্তির ভিত্তিতে স্থির করা হলো যে আমাদের চাহিদা জরুরিভাবে মেটানোর জন্য এবং তিনগুণ দাম দিয়ে LNG  গ্যাস আমদানির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আমরা তড়িঘড়ি করে কনকো ফিলিপসের সঙ্গে একটা চুক্তি করেছি যেটার ভিত্তি হচ্ছে  website-এ প্রকাশিত মডেল পিএসসি-২০০৮। এখন আমাদের দেখতে হবে এই চুক্তির বিধানগুলি কি আমাদের উল্লিখিত স্বার্থ ও যুক্তিগুলো বিবেচনায় নিতে সক্ষম হয়েছে? বিচারের সুবিধার্থে আমি আমাদের যুক্তির বা বিচারের মানদণ্ডগুলি এখানে পুনরায় উল্লেখ করতে চাই-

ক. আবিষ্কৃত গ্যাস/তেল ক্ষেত্রের ওপর এবং আহরিত গ্যাস ও তেলের ওপর বাংলাদেশের জনগণের মালিকানা সংরক্ষিত হয়েছে কি?

খ. কনকো ফিলিপকে উৎপাদন খরচ বাবদ আহরিত গ্যাসের-তেলের কত অংশ দিতে হতে পারে এবং মুনাফা বাবদ কত অংশ দিতে হতে পারে। এসব দেয়ার পর বাংলাদেশের প্রাপ্য অংশটি কত দাঁড়ায় এবং সেটার মাত্রা গ্রহণযোগ্য কি?

গ. গ্যাসের দাম কত নির্ধারিত হবে। তা কি বর্তমান দামের তিনগুণেরও বেশি হবে অর্থাৎ LNG আমদানি করতে যে দাম দিতে হয় তার চেয়ে বেশি হবে? তাহলে গ্যাস তোলার ঝামেলায় না গিয়ে গ্যাস LNG রূপে আমদানিই কি শ্রেয় নয়?

ঘ. গ্যাস কার কাছে বিক্রি হবে এবং কোথায় তা ব্যবহৃত হবে? আমি না কিনতে পারলে সেটা কি বাইরে রপ্তানি হয়ে যাবে না? আমি কি যথাযত দামে সবটা গ্যাস কিনে দেশেই ব্যবহার করে জ্বলানি নিরাপত্তা রক্ষা করতে সক্ষম হব?

চুক্তির খুঁটি-নাটি ও ফাঁক-ফোকড়ের বিশ্লেষণ

এখন আমরা উপরোক্ত প্রশ্ন বা মানদণ্ডগুলিকে সামনে রেখে পিএসসি মডেল চুক্তি ২০০৮-এর বিশ্লেষণ করবো। বর্তমান চুক্তির অধীনে আছে যে যদি গ্যাস বা তেল আবিষ্কার হয় এবং তখন যদি তা বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক বলে প্রমাণিত না হয় তাহলে পেট্রোবাংলাকে তা বিনামূল্যে অফার করা হবে। নিজ খরচে পেট্রোবাংলা তা উত্তোলন ও ব্যবহারোপযোগী করে ব্যবহার করতে পারবে অথবা জ্বালিয়ে দিতে পারবেন। [দেখুন চুক্তির ১৫.১, ১৫.২ ও ১৫.৩ ধারা। এখানে এই কথাটিই টেশনিকাল ভাষায় লেখা আছে।] এখানে অবশ্য আরো বলা হয়েছে যে যদি গ্যাসের বদলে তেল ও গ্যাস উভয়ই পাওয়া যায় তাহলে তেল উত্তোলনের জন্য যেটুকু গ্যাস প্রয়োজন হবে আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী ইজারাদার সেটুকু গ্যাস বিনামূল্যে ব্যবহারের অধিকার পাবে।

এটি হচ্ছে সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক একটি অবস্থা যেখানে কিছুই আমরা পাচ্ছি না। ওরাও কিছুই পাচ্ছেন না। তবে যদি গ্যাসের বদলে তেল পাওয়া যায় তখন কি হবে সেটি আরেকটি আলোচনার বিষয় এবং তার বিশ্লেষণের যাত্রাবিন্দুটি এখানে উল্লেখিত হলো।

এর পরের উল্লেখযোগ্য ধারাটি হচ্ছে ১৫.৪ ধারা। এখানে বলা হয়েছে ইজারাদার স্বীকৃত রিজার্ভার ম্যানেজমেন্ট নীতি অনুসারে প্রতি গ্যাসক্ষেত্রের প্রমাণিত মজুদের শতকরা সাড়ে সাত ভাগ (৭.৫) গ্যাস উত্তোলন করতে পারবে। এই ধারাটি আমাদের পক্ষে, কারণ যত কম করে গ্যাস তোলা হবে তত বেশিদিন গ্যাস ক্ষেত্রটি জীবিত থাকবে। আমাদের জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য কম করে বেশি দিন যাবত গ্যাস ভোগ করাটাই শ্রেয়। বিপরীত ক্রমে যদি ২৫% বা ততোধিক গ্যাস তোলার সুযোগ খুলে দেয়া হতো তাহলে মাত্র চার বছরে গ্যাস ক্ষেত্রগুলি নিঃশেষিত হয়ে যেত এবং তখন এত বেশি গ্যাস উত্তোলিত হোত যে আমাদের ভোগচাহিদা মিটিয়ে বাকি উদ্বৃত্ত গ্যাস বিদেশে রপ্তানির বাধ্য-বাধকতা চলে আসতো। পারে অবশ্য আবার অনেক দামে গ্যাস আমদানির বাধ্য-বাধকতাও চলে আসতো। আর এটা

বিদেশীদের জন্য লাভজনক হোত কারণ অল্প সময়ে তারা তাদের বিনিয়োগ খরচ তুলে নিতে সক্ষম হতেন। এ পর্যন্তই যদি সমস্ত কথা শেষ হয়ে যেত তাহলে কোনো কথাই আর ছিল না। মডেল পি.এস. সি-২০০৮-এর ১৫.৪ ধারায় এই কথাগুলি লেখার পরেই একটি তৃতীয় বন্ধনীর মধ্যে নিম্নোক্ত কথাগুলি জুড়ে দেয়া হয়েছে-[‘বি : দ্র : অফশোর বস্নকের ক্ষেত্রে পেট্রোবাংলার সম্মতিক্রমে শতকরা সাড়ে সাত ভাগের চেয়েও বেশি গ্যাস উত্তোলন করা যাবে’] শুভংকরের ফাঁকটা তাই অফশোর গ্যাসের জন্য এই জায়গায় রেখে দেয়া হলো। চূড়ান্ত চুক্তিতে এ ধারাটি আরো শিথিল করা হলে তখন সুযোগ থাকবে বেশি উৎপাদনের এবং সেই সূত্রে অনিবার্য রপ্তানির সুযোগ! যদিও তা আন্তর্জাতিক রিজার্ভয়ের ম্যানেজমেন্টের নীতির পরিপন্থী বলে চুক্তিতেই তা আমরা বাধ্যতামূলক ভাবে না করে দিতে পারতাম। তবু এই ছাড় কেন?

এবার আমরা দৃষ্টি দেবো সবচেয়ে বিতর্কিত এবং সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ ধারাটির দিকে ১৫.৫.১ ধারায় খুবই জটিলভাবে বলা হচ্ছে,

“১৫.৫.৪, ১৫.৫.৫, ১৫.৬ ধারায় বর্ণিত হিসাবনুসারে কন্ট্রাক্টর চুক্তিকৃত এলাকায় উৎপাদিত যে কোন পরিমান মার্কেটবল গ্যাস এল.এন.জি রপ্তানির অধিকার পাবে। রপ্তানিতব্য প্রাকৃতিক গ্যাসের পরিমাণ নিম্নরূপ হবে-

(ক) কন্ট্রাক্টর-এর কষ্ট রিকভারি গ্যাস।

(খ) কন্ট্রাক্টর-এর প্রফিট গ্যাস

(গ) পেট্রোবাংলার প্রফিট গ্যাসঅথবা যে ক্ষেত্রে প্রযোজ্য সে ক্ষেত্রে ১৫.৫.৪ ধারা বর্ণিত শর্তে প্রাপ্ত পেট্রোবাংলার সীমিত প্রফিট গ্যাস।’’

এই ধারার ২টি অংশ। প্রথম অংশে রয়েছে কতকগুলি শর্তের কথা-১৫.৫.৪, ১৫.৫.৫ এবং ১৫.৬। এই শর্তগুলি যদি কনোকো ফিলিপ পূরণ করতে পারে তাহলে LNG রূপে সকল গ্যাসই অর্থাৎ ১০০ শতাংশ গ্যাসই সে রপ্তানি করতে পারবে!

আমরা সকলেই যেটা সর্বদা Bottom Line হিসেবে বলে এসেছি এবং প্রধানমন্ত্রীও যার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ তা হচ্ছে জ্বালানি নিরাপত্তা বজায় রাখতে হবে। অর্থাৎ ২০৫০ সাল পর্যন্ত গ্যাস-কয়লা-তেলের মজুদ রেখে তারপরেও যদি বাড়তি অনবায়নযোগ্য জ্বালানি থাকে একমাত্র তখনই তা রপ্তানির কথা ভাবা যেতে পারে। কোনো অবস্থাতেই কোনো চুক্তিতে এমন সুযোগ থাকা উচিত হবে না যাতে এই জ্বালানি নিরাপত্তার লক্ষ্য বিপর্যস্ত হয়। অর্থাৎ কখনোই আমাদের চাহিদা পূরণ না করে বাইরে অনবায়নযোগ্য জ্বালানি রপ্তানি করবো না। এবং আমাদের এই চাহিদার হিসাবটা করতে হবে ২০৫০ সাল পর্যন্ত গতিশীল প্রণালীতে। বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে আমরা জানি যে ২০০৯ সালের জুলাই মাসে আমাদের মোট গ্যাস উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ১৯৪৫ মিলিয়ন ঘনফুট সে ক্ষেত্রে দৈনিক চাহিদা ছিল ২১৮০ মিলিয়ন ঘনফুট, অর্থাৎ দৈনিক মোট রেজিস্টার্ড ঘাটতি ছিল ২৩৫ মি: ঘনফুট বা মোট উৎপাদন ক্ষমতার ১২ শতাংশ। আর এর সঙ্গে যদি পটেনশিয়াল শিল্প কারখানার চাহিদাগুলিও যোগ করা হয় তাহলে ২০০৯ সালের জুলাই মাসেই আমাদের গ্যাস ঘাটতি ছিল মোট উৎপাদন ক্ষমতার প্রায় ২০ শতাংশ। [ মোঃ নুরুল ইসলাম, ‘‘তেল গ্যাস কয়লা রপ্তানি নিষিদ্ধ করে আইন পাস করা উচিত’’, সাপ্তাহিক, ১০ই জুলাই, ২০০৯ দ্র: ] সুতরাং সব মিলিয়ে কোনো চুক্তিতে কোনোভাবেই শতকরা একশত ভাগ LNG রূপে গ্যাস রপ্তানির সুযোগ রাখা উচিত হবে না। কিন্তু এই ২০০৮-এর পি. এস. সি-তে সুযোগ রয়েছে। এটাই আমাদের অভিযোগ। এই বক্তব্যের বিরুদ্ধে দু’ ধরনের পাল্টা বক্তব্য রয়েছে-

ক. যদি ৫-৬ ট্রিলিয়ন গ্যাস আবিষ্কৃত না হয় তাহলে LNG plant করাটাই লাভজনক হবে না। সে জন্যই ১৯৯৭-এর পরে সাধিত সব PSC-তেই LNG form-এ গ্যাস রপ্তানীর সুযোগ থাকলেও ওই সুযোগ কোনো বহুজাতিক কোম্পানি আজ পর্যন্ত ব্যবহার করেনি। এবারো এই সুযোগটি তাত্ত্বিক সুযোগ মাত্র, ব্যবহারিক সুযোগ এটা নয়।

খ) আর যদি ৫-৬ ট্রিলিয়ন গ্যাস পাওয়াই যায় তাহলেও LNG Plant করার আগে তাদের ১৫.৫.৪ এবং ১৫.৫.৫ এবং ১৫.৬ শর্ত পূরণ করতে হবে এবং সেটা পূরণ করতে পারবে না বলেই গ্যাস রপ্তানি অসম্ভব হয়ে যাবে।

প্রথম যুক্তিটি ‘অজ্ঞানের’ খড়-কুটো ধরে শেষ মুহূর্তে নিজেকে বাঁচানোর একটা কৌশল। না জেনে অনুমান করাটা যে বৈধ নয়-এই কথাটা এখানে ভুলে যাওয়া হয়েছে। বিশাল গ্যাস ভাণ্ডার আবিস্কার হবে না এটাই বা তারা জানলেন কিভাবে? আর যদি কমই হয় তাহলে খরচ মিটবে কি? খরচ মিটিয়ে কতটুকুই বা আমাদের থাকবে- সে প্রশ্ন তো থেকেই য়াচ্ছে। সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে রপ্তানি ঠেকানোর জন্য এখন আমাদেরকে কম গ্যাসের প্রত্যাশার দোহাই দিতে হচ্ছে!

দ্বিতীয় যুক্তিটি বুঝতে হলে LNG রপ্তানির সুযোগ সংক্রান্ত ধারাটি এবং তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ওই শর্তগুলিতে কী লেখা আছে তা আমাদের সতর্কতার সঙ্গে বিচার করে দেখতে হবে। শর্তগুলি কি রপ্তানির বিরুদ্ধে Binding Constraint না কি সেগুলি লঙ্ঘনের সুযোগ সেগুলির মধ্যেই বিদ্যমান রয়েছে-সেটি বিচার করা দরকার।

১৫.৫.৪ ধারার প্রাসঙ্গিক গুরম্নত্বপূর্ণ অংশটিতে বলা হয়েছে, ‘‘যে ক্ষেত্রে পেট্রোবাংলা স্থানীয় চাহিদা মিটাতে প্রয়োজনীয় পরিবহন ব্যবস্থা (পাইপ লাইন) স্থাপন করতে পারবে সেক্ষেত্রে পেট্রোবাংলা তার অংশের প্রোফিট গ্যাস রাখার অধিকারপ্রাপ্ত হবে, তবে তা কোনো মতেই মোট ‘মার্কেটেবল গ্যাস’ (অর্থাৎ মোট উৎপাদিত গ্যাস = কষ্ট রিকভারি গ্যাস + কনকো ফিলিপের প্রফিট গ্যাস + পেট্রোবাংলার প্রফিট গ্যাস) এর ২০%-এর বেশি হবে না। প্রতি মাসে পেট্রোবাংলা যে পরিমান গ্যাস স্থানীয় ব্যবহারের জন্য রাখতে চায় কন্ট্রাক্টরকে এল. এন. জি রপ্তানি চুক্তির আগে জানাতে হবে এবং প্রতিমাসে সংরক্ষিত চুক্তির পূর্ণমেয়াদকাল পর্যন্ত বলবত থাকবে। পেট্রোবাংলার অনুরোধে ১১তম বছরের শুরম্ন থেকে উপরে বর্ণিত সংরক্ষিত গ্যাসের পরিমান শতকরা ২০ ভাগ থেকে বৃদ্ধি করে ৩০ ভাগ পর্যন্ত করা যাবে।’’

সুতরাং কথা খুব পরিষ্কার। এখানে কনকো ফিলিপ অনেকটা মালিকের মতোই আমাদেরকে জিজ্ঞেস করছে, ‘কতটা গ্যাস আপনি স্থানীয় ব্যবহারের জন্য রাখতে চান?’ আমার চাহিদা যাই থাকুক না কেন, ভবিষ্যত জ্বালানি নিরাপত্তা যতই বিঘ্নিত হোক না কেন-প্রথম ১০ বছর আশি ভাগ গ্যাস রপ্তানি করার অধিকার কনোকো ফিলিপকে পরিষ্কারভাবে দিয়ে দেয়া হয়েছে। অতএব ১৫.৫.৪ শর্তটি গ্যাস রপ্তানীর বিরম্নদ্ধে নয়, বরং রপ্তানির পদ্ধতিটির সুনির্দিষ্টায়নের একটি ধারা। সান্ত্বনা পুরস্কার রাখা হচ্ছে ১১তম বছরে এসে ৩০% গ্যাস স্থানীয় ব্যবহারের জন্য প্রাপ্তি এবং এর পরও যদি গ্যাস উৎপাদন অব্যাহত থাকে তাহলেও ঐ ৩০%-এর বেশি স্থানীয় ব্যবহারের জন্য কখনোই পাওয়া যাবে না। তা সে যতই আমাদের প্রয়োজন থাকুক না কেন। এর ফলে এমন অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে যখন আমরা একই সঙ্গে LNG form-এ রপ্তানি করবো কম দামে এবং অপেক্ষাকৃত বেশি দামে LNG গ্যাস আমদানি করবো বিদেশ থেকে। যদি ওই সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ দিয়েও আমাদের অভাব না মিটে তাহলে সেটাই আমাদের করতে হবে। তবে পেট্রোবাংলা যদি পাইপ লাইনের খরচ দিয়ে স্থলভাগে নিজেরা গ্যাসটা আনতে না পারে তাহলে ওই শতকরা ২০ ভাগ রাখার অধিকারও পেট্রোবাংলার থাকবে না, ৩০ শতাংশ তো দূর-অস্থ।

১৫.৫.৫ উপশর্তে বলা হয়েছে, ‘‘এল. এন. জি. রপ্তানিমূল্য বা রপ্তানি মূল্যের ফর্মুলা পেট্রোবাংলা কর্তৃক অনুমোদনের আগে কন্ট্রাক্টর এল. এন. জি. রপ্তানির কোনো চুক্তি করবে না।’’ কেউ কেউ বলেন এই তো মোক্ষম যুক্তি, আমরা যদি রপ্তানি মূল্যের ফর্মুলায় এক মত না হই তাহলে তো রপ্তানি আটকে যাচ্ছে। কিন্তু ১৫.৫.৫ উপধারায় এর পর পরই আরো লেখা হয়েছে-

‘‘কন্ট্রাক্টর যদি দেখাতে পারে যে, এল.এন.জি রপ্তানির মূল্য বা মূল্য নির্ধারণী ফর্মুলা ন্যায্য, তাহলে পেট্রোবাংলা তার অনুমোদন আটকে রাখবে না। যে ভৌগলিক এলাকায় রপ্তানি করা হবে তার নাম ও প্রকৃতি এবং রপ্তানির স্থান থেকে বাজার পর্যমত্ম পরিবহন ব্যয় পেট্রোবাংলার কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে।’’

তাহলে শেষ পর্যন্ত কি দাঁড়াল? কনোকো ফিলিপস যদি আন্তর্জাতিক বাজার দরে (ধরুন ১৩ ডলারে!) এল.এন.জি গ্যাস ভারতকে রপ্তানির প্রস্তাব দেয় তাহলে কি পেট্রোবাংলা ওই প্রস্তাবকে ‘অন্যায্য দাম’ বা ‘ভারত আমাদের শত্রু দেশ, অতএব তাকে রপ্তানি করা যাবে না’ এরকম যুক্তি প্রয়োগ করে রপ্তানি ঠেকাতে পারবে? যদি না পারা যায় তাহলে ওই শর্ত থাকলেই কি, না থাকলেই কি!

১৫.৬ নং উপশর্তটি বা শেষ উপশর্তটি নিয়েই যত জটিলতা। এর রয়েছে তিনটি উপশর্ত। প্রথম শর্তে বলা হয়েছে, ’’কন্ট্রাক্টর তার প্রাপ্য কষ্ট রিকভারি গ্যাস এবং প্রফিট গ্যাস বিক্রয়ের জন্য পেট্রোবাংলাকে প্রথম প্রস্তাব দেবে। পেট্রোবাংলা সে প্রস্তাব গ্রহণ করবে অথবা তার এফিলিয়েটেড কোম্পানি উক্ত গ্যাস ক্রয় করবে। চুক্তিভুক্ত এলাকার বাইরেও যদি অতিরিক্ত গ্যাস মজুদ আবিস্কৃত হয় সে ক্ষেত্রেও উৎপাদন এলাকা থেকে গ্যাস সরবরাহের বাধ্য-বাধকতা হ্রাস পাবে না। ডেভেলাপমেন্ট প্লান অনুমোদনের সময় গ্যাস ক্রয় এবং বিক্রয়ের জন্য চুক্তির শর্তসমূহ ১৫.৭ ধারায় বর্ণিত আর্থিক হিসাব অনুসারে প্রণয়ন করতে হবে।’’

১৫.৬ এর (বি) উপধারায় আরো বলা হয়েছে মূল্যায়ন প্রতিবেদন দাখিলের ৬ মাসের মধ্যে পেট্রোবাংলা যদি গ্যাস ক্রয়ের নিশ্চিত প্রতিশ্রুতি দিতে সক্ষম না হয় তাহলে কনোকো ফিলিপস বাংলাদেশের ভেতরে যে কোনো তৃতীয় পক্ষকে গ্যাস বিক্রি করতে পারবে এবং পেট্রোবাংলা শুধু তা মানলেই চলবে না তাকে সেই বিক্রির ব্যাপারে সাহায্যও করতে হবে।

১৫.৬ (সি) তে আরো স্পষ্ট ভাবে বলা হয়েছে, ’’কন্ট্রাক্টর তার প্রাপ্য অংশের গ্যাস পেট্রোবাংলার কাছে বিক্রির প্রসত্মাব দিবে। পেট্রোবাংলা যদি ক্রয় করতে অস্বীকার করে সে ক্ষেত্রে কন্ট্রাক্টর গ্যাস দেশের অভ্যমত্মরে তৃতীয় পক্ষের কাছে বিক্রি করতে পারবে।’’

এই ১৫.৬ উপধারার এবিসি শর্তগুলো তখনই গ্যাসের অভ্যন্তরীণ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারবে যখন পেট্রোবাংলা এই বৃহৎ আইওসি’র সঙ্গে গ্যাস বিক্রির আর্থিক শর্তটি তথা দাম নির্ধারণে প্রথমে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারে এবং ওই দামে তা নিজে কিনতে রাজী হয়। অধ্যাপক নুরুল ইসলাম বলেছেন, চুক্তির ১৫.৭ ধারায় দাম নির্ধারণের যেসব পদ্ধতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে তা ব্যবহার করে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন দাম এখনই হিসাব করা সম্ভব।

 

এখানে কষ্ট বিকভারি ও প্রফিট গ্যাসের মোট পরিমাণ যাই হোক না কেন, কনোকো ফিলিপের জন্য যেটা প্রধান বিবেচ্য সেটা হচ্ছে দ্রুত পুঁজির টাকাটা উদ্ধার করে নেওয়া। যেহেতু তৃতীয় পক্ষের কাছে বা এলএনজিতে গ্যাস বিক্রি করতে পারলে তিন গুণ বেশি দাম পাওয়া যাবে এবং সেখানে লাভের হার অনেক বেশি হবে সেহেতু কনোকো ফিলিপের প্রচেষ্টা হবে তিন গুণ দামে রপ্তানী করা বা নিদেন পক্ষে দেশের ভেতরে সর্বোচ্চ দরদাতাকে বিক্রি করা। এমনও হতে পারে যে টাটা এখানে রপ্তানিমুখী যে বিনিয়োগ করতে ইচ্ছুক ছিলেন এবং যার জন্য সে ২০ বছরব্যাপী নিশ্চিত গ্যাস বা কয়লা সরবরাহের চুক্তি করতে চেয়েছিল সেই সম্ভাবনারই প্রথম পদক্ষেপে পরিণত হবে এই গ্যাস আহরণ চুক্তি। সুতরাং দেখা যাচ্ছে উপশর্তগুলি রপ্তানির বিরুদ্ধে Binding Constraint নয়। আমরা কি এখনই চুক্তিতে যা যা লেখা আছে তা মেনে চলার জন্য তথাকথিত ’’সভ্য-ভদ্র-নির্লোভ’’ বহুজাতিক IOC-গুলিকে বাধ্য করতে পারছি? তবে একথা ঠিক এখন পর্যন্ত তাদের ইচ্ছা সত্ত্বেও তারা গ্যাস রপ্তানি করতে সক্ষম হয়নি। কিন্তু সেটা ছিল স্থলভাগে এবং পাইপের মাধ্যমে পাঠানো গ্যাসের ইস্যু, ফলে বোধগম্য কারনেই এখানে জনপ্রতিরোধের শক্তি ছিল অনেক বেশি। পেট্রোবাংলা কিন্তু প্রতিরোধ তো দুরের কথা বরং যখন IOC রপ্তানি করতে ব্যর্থ হোল তখন চুক্তির বাইরে গিয়ে তাদেরকে বেশী দামে তৃতীয় পক্ষের কাছে বেশি দামে গ্যাস বিক্রির সুযোগ করে দিয়েছিল। ভবিষ্যতেও যদি পেট্রোবাংলার একই প্রবণতা অব্যাহত থাকে তাহলে চুক্তিতে রয়ে যাওয়া এসব ফাঁক-ফোকরের কি ভয়াবহ পরিণতি হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।

উপসংহার

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজন স্থগিত রাখার ঝুঁকি নিযে কেন আমরা এলএনজি রূপে ১০০ ভাগ গ্যাস রপ্তানির এই সুযোগটি চুক্তিতে রেখে দিচ্ছি। যদি জ্বালানি নিরাপত্তা আমাদের আদর্শ হয় তাহলে এখনো কেন ৫০ বছর পর্যন্ত অনবায়নযোগ্য জ্বালানি রপ্তানি স্থগিত শীর্ষক প্রস্তাবিত আইনটি সংসদে আলোচিত হয়ে গৃহীত হচ্ছে না? কেন সম্প্রতি অনুমোদিত ২০০৯-১২ সালের জন্য প্রণীত রপ্তানি নীতিতে এই প্রথমবারের মতো রপ্তানি নিষিদ্ধ পণ্যের তালিকা থেকে বিশেষ ভাবে এলএনজি গ্যাসকে বাদ রাখা হলো। রপ্তানি নীতি ২০০৯-১২’র পরিশিষ্টঐক এর ৮.১ (ক) ধারায় রপ্তানি নিষিদ্ধ পণ্যের তালিকার নীচেই লেখা হয়েছে:

‘‘সকল পেট্রোলিযাম এবং পেট্রোলিয়াম জাত উৎপাদন, তবে প্রাকৃতিক গ্যাস জাত দ্রব্য ছাড়া (যেমন, ফার্নেস অয়েল, লুব্রিকান্ট অয়েল, বিটুমিন, কনডেনসেট, এমটিটি, এমএস)।’’ তারপরেই আবার লেখা হয়েছে, ’’অবশ্য এই নিষেধাজ্ঞা উৎপাদন বণ্টন চুক্তির অধীনে বিদেশি বিনিয়োগকারী সংস্থাসমূহের অংশ পেট্রোলিয়াম বা এলএনজি রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না।’’

এসব কিছু কিসের আলামত? আলামত একটাই। তা হচ্ছে আমাদের গ্যাস রপ্তানির সুযোগ এখন আমরা খোলা রেখে দিচ্ছি। পরে তা বাস্তবায়িত করবো বা দেখাবো যে করতে বাধ্য হলাম।

লেখক :  অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

(২৪ জুন ২০১১ শুক্রবার প্রগতি সম্মেলন কক্ষ, মুক্তি ভবন-এ তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির উদ্যোগে ‘‘কনকো ফিলিপস-এর সাথে তেল-গ্যাস চুক্তি কেন জাতীয় স্বার্থ পরিপন্থি ?’’- শীর্ষক আলোচনা সভায় পঠিত।)

১.০ সূচনা

১। মহাজোটের সরকারের আমলে বাংলাদেশের জ্বালানি সমস্যা ক্রমান্বয়ে তীব্র থেকে তীব্রতর হতে চলছে। বাংলাদেশের জ্বালানি সংকটের প্রধান কারণগুলো হচ্ছে জ্বালানি সেক্টরের বিভিন্ন নিয়ামক সম্বন্ধে সিদ্ধান্তগ্রহণকারীদের অজ্ঞতা, অব্যবস্থাপনা এবং পরিকল্পিত দুর্নীতি। গত দু’বছর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দেশে দুর্নীতি নিয়ে যে পরিমাণ হৈচৈ হয়েছে, জ্বালানি সেক্টরের সংঘটিত ও বিদ্যমান দুর্নীতি তার তুলনায় হাজার গুণ বেশী। দুর্নীতির প্রকার ও পরিমাণ সম্বন্ধে জনগণের ধারনা নেই বলে বিষয়গুলো আলোচিত ও প্রকাশিত হয়নি। জ্বালানি সেক্টরের দুর্নীতির কৌশল হলো দেশের জনগণের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে নিজেরা সামান্য কিছু সুবিধা পাওয়ার বিনিময়ে বিদেশী ও দেশী স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠিকে বিশাল প্রাপ্তির সুযোগ করে দেয়া।

২। দেশের একটি কুচক্রীমহল আইনি চাদর পরিয়ে এ সুবিধাগুলো পাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়। আইনি চাদর পরাবার প্রয়োজনে বিদেশী কোম্পানিগুলো দেশের অত্যন্ত নামিদামি আইনজ্ঞদেরকে অতি উচ্চ মূল্যে তাদের আইন উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ করে। এসকল বিখ্যাত আইন উপদেষ্টারা অতিসহজেই সরকারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষে উপদেশ দানকারী অপেক্ষাকৃত কম অভিজ্ঞ আইনজ্ঞ/সরকারী আইন কর্মকর্তাদেরকে আইনি লড়াইয়ে হারিয়ে দিয়ে দেশের স্বার্থ বিরোধী চুক্তিকে আদালতে প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করে।

৩। বাংলাদেশের দুর্নীতির মহাসমুদ্রে দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা অত্যন্ত সীমিত। তা কতকটা ঝাকি জাল দিয়ে পুঠি মাছ ধরার অনুরূপ। স্বাভাবিক কারণে জ্বালানি সেক্টরে বিচরনকৃত বড় ধরনের দুর্নীতিবাজরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। এরফলে সরকার পরিবর্তন হলেও জ্বালানি সেক্টরের দুর্নীতির কর্মকান্ড বক্তৃতা ও আলোচনার মধ্যেই সীমিত থাকে। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের কোন লক্ষণ দেখা যায় না।

৪। জ্বালানি সেক্টরের গত বিশ বছরের কর্মকান্ড পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, নূতন সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে যে কাজগুলো করেন তাহলো অতীত সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে বক্তৃতা প্রদান করা এবং জনগণেকে ”আয় আয় চাঁদ মামা টিপ দিয়ে যা বলে সুর করে ঘুম পড়ানোর ছড়াগান শুনান”। সে ছড়া গানের সুরে যা থাকে তা হলো রিনিউয়েবল এনার্জী দিয়ে জ্বালানি সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতি, বিদেশ থেকে গ্যাস/এলএনজি আমদানী করে এবং নেপাল, ভূটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানী করে গ্যাস ও বিদ্যুতের চাহিদা মিটানো এবং নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করে বিদ্যুতের সমস্যা সমাধান করা। দীর্ঘ মেয়াদি এ প্রস্তাবনাগুলো বাস্তবায়নের কৌশল সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের ধারনা না থাকার কারণে চার-পাঁচ বছরে এ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হয় না। কিছুদিন পর জ্বালানি সমস্যায় জর্জরিত জনগণ এগুলিকে অবাস্তব কল্পনা হিসেবে ভাবতে শুরু করে। পেটে ক্ষুধা থাকলে যেমন শিশুরা চাঁদ মামার টিপ দেয়ার গল্পে ঘুমিয়ে পরে না তেমনি জ্বালানি সমস্যা লাঘব না হলে সিদ্ধান্তগ্রহণকারীদের শুধু প্রতিশ্রুতি শুনে জনগণ বেশী দিন তুষ্ট থাকতে পারে না।

৫। কোন দেশে চাহিদার চেয়ে অনেক অনেকগুণ বেশী নিজস্ব জ্বালানি সম্পদ থাকা সত্ত্বেও সেদেশের জনগণ জ্বালানিসহ অর্থনৈতিক সমস্যায় পড়তে পারে এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছে নাইজেরিয়া। ওপেকের সদস্য হিসেবে প্রতিবছর কোটি কোটি ব্যারেল তেল রপ্তানি করার পরেও দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে আশি ও নব্বইয়ের দশকে নাইজেরিয়া অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছিল। যা এখন প্রবাদ বাক্য হিসেবে ”নাইজেরিয়করণ” নামে পরিচিত। অনেক দুঃখ দুর্দশা সহ্য করে নব্বইয়ের দশকের পর নাইজেরিয়া ঘুরে দাড়াতে শুরু করেছে; সে দেশের সাধারণ মানুষ জ্বালানি সম্পদ থেকে কিছুটা সুবিধা পেতে শুরু করেছে।

৬। গত বিশ বছরে বাংলাদেশে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত বিভিন্ন সরকারের আমলে (স্বৈর সরকার/প্রথম গণতান্ত্রিক সরকার/দ্বিতীয় গণতান্ত্রিক সরকার/জোট সরকার/তত্ত্বাবধায় সরকার/মহাজোট সরকার) বাংলাদেশের জ্বালানি সেক্টরে দেশের স্বার্থবিরোধী বড় ধরনের দুর্নীতির যেসকল ঘটনা ঘটেছে বলে আলোচিত হয় তা নিম্নে উপস্থাপন করা হলো-

(ক) কাফকোর কাছে কম দামে গ্যাস বিক্রি করে আন্তর্জাতিক বাজার দরে সার ক্রয়ের চুক্তি;
(খ) কোন দরপত্র ছাড়া আবিস্কৃত জালালাবাদ গ্যাস ক্ষেত্র অক্সিডেন্টাল কোম্পানির কাছে লীজ প্রদান;
(গ) সমুদ্র অঞ্চলে অবস্থিত সাঙ্গু গ্যাস ক্ষেত্র থেকে উৎপাদিত গ্যাসের সর্বোচ্চ মূল্যের (প্রতি এমসিএফ ২.৭৭ ডলার) চেয়ে স্থলভাগে অবস্থিত জালালাবাদ গ্যাস ক্ষেত্র থেকে বেশী সর্বোচ্চ মূল্যে (প্রতি এমসিএফ ৩.২৩ ডলার) গ্যাস ক্রয়ের চুক্তি;
(ঘ) সেভ্রনের কাছ থেকে বেশী দামে (প্রতি এমসিএফ ৩.২৩ ডলার) গ্যাস ক্রয় করে লাফার্জ সিমেন্ট কারখানার কাছে কমদামে (প্রতি এমসিএফ গ্যাস ২.৮ ডলার) বিক্রয়ের চুক্তি;
(ঙ) ফুলবাড়ী কয়লা উন্নয়ন চুক্তি;
(চ) বাপেক্স-নাইকো জয়েন্টভেঞ্চার চুক্তি;
(ছ) মাগুরছড়া গ্যাস ক্ষেত্রের বিষ্ফোরনের ক্ষতি-পূরন না নেয়ার বদলে ৫% এর চুক্তি;
(জ) সেভ্ররনকে জালালাবাদ গ্যাস ক্ষেত্রের বাহিরের এলাকায় গ্যাস অন্বেষণ ও উন্নয়নের অনুমতি প্রদান;
(ঝ) জিটিসিএল এর কম্প্রেসার ক্রয়ের আন্তর্জাতিক দরপত্র বাতিল করে সেভ্ররনের মাধ্যমে কোন দরপত্র ছাড়া একটি কম্প্রেসার স্থাপনের সুযোগ প্রদান (ডেইলী স্টার: ৩০ আগষ্ট, ২০০৯);
(ঞ) পিএসসিতে শতকরা ৮০ ভাগ রপ্তানির সুযোগ রেখে সমুদ্রাঞ্চলের তিনটি ব্লকে ইজারা প্রদান;
(ট) এশিয়া এনার্জির বেআইনী ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্পকে বৈধতা দেয়ার উদ্দেশ্যে কয়লানীতি প্রণয়ন।

৭। উপরে বর্ণিত চুক্তিগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, এগুলোর সূচনা এবং বাস্তবায়নের সময়কাল একাধিক সরকারের শাসনকাল ধরে বিস্তৃত। একথার অর্থ হলো যে, দেশের সরকার পরিবর্তন হলেও দুর্নীতিবাজরা একে অপরের যোগসাজোগে দেশের স্বার্থবিরোধী এসকল কর্মকান্ড চালিয়ে গেছে এবং এখনও চালাচ্ছে। উদাহরণসরূপ বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে গৃহীত সমুদ্রাঞ্চলের বিতর্কীত পিএসসিগুলো মহাজোট সরকার অনুমোদন প্রদান করেছে। অতীতের ঘটনাসমূহ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, দেশী-বিদেশী স্বার্থন্বেষীমহল নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য ক্রমাগতভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যায় এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য রাজনৈতিকভাবে অস্থির সময়কে বেছে নেয় এবং সফলতা অর্জন করে। সরকার পরিবর্তনের শেষ পর্যায়ে এবং/অথবা নূতন সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের শুরুতে (অনভিজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে) এধরনের উদ্যোগের প্রকাশ বেশী দেখা যায়।

৮। উপরে উল্লেখিত জ্বালানি সেক্টরের দুর্নীতি সম্বন্ধীয় বিতর্কীত বিষয়গুলোর সাথে পেট্রোবাংলা এবং জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ সম্পৃক্ত। মাঝে মাঝে শোনা যায় যে এসব সহযোগিতার জন্য পেট্রোবাংলার কোন কোন চেয়ারম্যান পরবর্তীতে উচ্চ পদের চাকুরী পেয়েছেন, আবার কেউ চাকুরীতে এক্সটেনশন পেয়েছেন। আবার পেট্রোবাংলার কোন কোন চেয়ারম্যান দেশের স্বার্থ বিরোধী চুক্তিতে সম্মত না হওয়ার কারণে নিগৃহীত ও লাঞ্চিত হয়েছেন। ২৯ আগষ্ট ২০০৯ তারিখে প্রয়াত পেট্রোবাংলার প্রাক্তন চেয়ারম্যান জনাব এস,আর, ওসমানিকে টাটার ২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে সস্তায় নিশ্চিত গ্যাস সরবরাহ প্রস্তাবে সায় না দেয়ায় বিসিকের চেয়ারম্যান হিসেবে বদলী করা হয়েছে (ডেইলী স্টার: ৩০ আগষ্ট, ২০০৯)। বর্তমান সরকারের আমলে হলে হয়তো চাকুরীচ্যুত হতে হতো। অন্যদিকে দেশের স্বার্থ বিরোধী টাটার বিনিয়োগ প্রস্তাব সম্বন্ধে দেশের নাম করা সংবাদ মাধ্যম এবং বিখ্যাত বুদ্ধির পুকুর (ঞযরহশ ঞধহশ) হিসেবে পরিচিত গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষকরা অনেক প্রশংসা করে সরকারকে তরিৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার জন্য প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছে। অন্যদিকে পেট্রোবাংলার পরবর্তী চেয়ারম্যান একজন সাহসী ও দেশ প্রেমিক আমলা (ব্যুরোক্রাট) জনাব ওসমানীর ন্যয় দেশের পক্ষে (গ্যাসের ন্যায্য মূল্য ও সরবরাহের বিকল্প ব্যবস্থা প্রস্তাব করে) দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করার কারণে টাটা বাংলাদেশ থেকে তাদের বহুল প্রচারিত বিনিয়োগ প্রস্তাব তুলে নিতে বাধ্য হয়েছে। ভবিষ্যতে টাটাকে পুনরায় বিনিয়োগের সুযোগ করে দেয়ার জন্য সে দেশের সরকার ইতোমধ্যে ইচ্ছা প্রকাশ করেছে।

৯। দেশের স্বার্থ বিরোধী এসব বড় বড় চুক্তিগুলো বাস্তবায়নে সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করতে সংশ্লিষ্ট দেশের স্থানীয় কূটনীতিবিদেরকে সার্বক্ষনিকভাবে অনেক তৎপরতা চালাতে দেখা যায়। তারা সফল না হলে সংশ্লিষ্ট দেশের মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টদেরকে বাংলাদেশে ভ্রমনের আয়োজন করেন। তখন দেশের সংবাদ মাধ্যমে তাদের এ সফর দেশের ভাবমুর্তি বৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত সহায়ক বলে প্রচার করা হয়। এপ্রসঙ্গে নিকট অতীতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী জন মেজর, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন এবং ইদানিংকালে একাধিক ব্রিটিশ মন্ত্রীর বাংলাদেশ ভ্রমনের সময়কাল পর্যালোচনা করে দেখা যেতে পারে।

২.০ সমুদ্রাঞ্চলে ৩টি ব্লকে গ্যাস অনুসন্ধানের অনুমতি

১০। দেশের সংবাদ মাধ্যমে ৮০ ভাগ রপ্তানির সুযোগ রেখে সমুদ্রাঞ্চলে ৩টি ব্লকে গ্যাস অনুসন্ধানের অনুমতি প্রদানের জন্য প্রতিবাদ প্রচারিত হওয়ার পরে পেট্রোবাংলার বর্তমান চেয়ারম্যান এনার্জী এন্ড পাওয়ার এর ১ আগষ্ট, ২০০৯ তারিখের প্রকাশিত সংখ্যায় মত প্রকাশ করেছেন যে, সমালোচকদের পিএসসির একটি নির্দিষ্ট ধারা পড়ে সমালোচনা করা উচিত নয়। তাদের মডেল পিএসসি-২০০৮ এর সকল ধারা পর্যালোচনা করে মন্তব্য করা উচিৎ। দেশের প্রত্যেক সচেতন নাগরিকের পেট্রোবাংলার ওয়েব সাইট এ (www.petrobangla.org.bd) উপস্থাপিত উক্ত পিএসসির বিভিন্ন ধারা স্টাডি করার অনুরোধ করছি। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, পেট্রোলিয়াম অ্যাক্ট ১৯৭৪ অধীনে মডেল পিএসসি-২০০৮ প্রণয়ন করা হয়েছে। এবং পেট্রোলিয়াম অ্যাক্ট ১৯৭৪ এর মূল ভিত্তি হচ্ছে বাংলাদেশের সংবিধানের ১৪৩ অনুচ্ছেদে উল্লেখিত অধিকার। অনুমোদিত মডেল পিএসসি-২০০৮ এর ১৫ অধ্যায়ে উৎপাদিত প্রাকৃতিক গ্যাসের সম্ভাব্য ব্যবহার এবং দাম সম্বন্ধে বর্ণনা দেয়া আছে। উক্ত অধ্যায় থেকে বাছাইকৃত কয়েকটি ধারা মন্তব্যসহ নিম্নে উপস্থাপন করা হলো।

10.1| 15.5.1 Subject to Articles 15.5.4, 15.5.5 and 15.6 Contractor shall have the right to export any marketable natural gas as defined in Article 15.5.2 in the form of Liquefied Natural Gas (LNG). Such volume shall consist of:
a) Contractor’s Cost Recovery Natural Gas,
b) Contractor’s Profit Natural Gas, and
c) Petrobangla’s Profit Natural Gas or, where applicable, the remaining share of Petrobangla’s Natural Gas over the reservation pursuant to Article 15.5.4.

Where Contractor intends to export the Natural Gas as LNG, the related LNG facilities shall be constructed and operated on the basis of a special LNG export agreement between Contractor and Petrobangla. Such agreement shall allow, if appropriate, for the use of facilities by third parties.

10.2| Article 15.5.4 Where Petrobangla has installed necessary facilities to transport and use of gas to meet domestic requirements, Petrobangla shall be entitled at its option to retain natural gas produced upto Petrobangla’s share of profit gas but no more than 20% of the total marketable natural gas.

১০.৩। ১৫.৫.৪ ধারা পড়লে মনে হয় যে উৎপাদিত গ্যাসের মালিক কন্ট্রাক্টর (আইওসি); তারা পেট্রোবাংলাকে প্রয়োজনে স্থানীয় ব্যবহারের জন্য গ্যাস সংরক্ষন করতে দিবে। অনুবাদ করলে বুঝা যায় যেক্ষেত্রে পেট্রোবাংলা স্থানীয় চাহিদা মিটাতে প্রয়োজনীয় পরিবহন ব্যবস্থা (পাইপলাইন) স্থাপন করতে পারবে সেক্ষেত্রে পেট্রোবাংলা তার অংশের প্রোফিট গ্যাস রাখার অধিকার প্রাপ্ত হবে। তবে তা কোন মতেই মোট মার্কেটবল গ্যাসের ২০% এর বেশী হবে না। (১৫.৫.১ ধারা অনুসারে মার্কেটেবল গ্যাস বলতে (ক) কন্ট্রাকটারের প্রাপ্য কস্টরিকভারী গ্যাস, (খ) কন্ট্রাকটারের প্রাপ্য প্রফিট গ্যাস এবং (গ) পেট্রোবাংলার প্রাপ্য প্রফিট গ্যাস; অর্থাৎ সংক্ষেপে উৎপাদিত ১০০ ভাগ গ্যাস বুঝাবে)। পেট্রোবাংলা ১৯৭৪ সালে আবিস্কৃত নিকট সমুদ্রে অবস্থিত কুতুবদিয়া গ্যাস ক্ষেত্রকে ২০০৯ পর্যন্ত সময়কালে উৎপাদনে এনে সে গ্যাস দেশে ব্যবহারের জন্য পাইপলাইন স্থাপন করতে পারেনি সেক্ষেত্রে পেট্রোবাংলা গভীর সমুদ্রে অবস্থিত দূরবর্তী ব্লক থেকে স্থলভাগে গ্যাস পরিবহনের জন্য পাইপলাইন স্থাপন করা পেট্রোবাংলার পক্ষে অসম্ভব বলে প্রতীয়মান হয়। এই অযুহাতে পেট্রোবাংলা তখন ১০০% ভাগ বাজারজাতযোগ্য গ্যাস রপ্তানির অনুমতি দিতে বাধ্য হবে।

10.4| Article 15.5.5 Contractor shall not enter into any agreement for LNG export unless the price or the pricing formula and the agreement itself are previously approved by Petrobangla. Such approval shall not be withheld where Contractor can demonstrate that the price received or pricing formula established represents the fair market value at the point of export for LNG taking into account the volumes of LNG export to be sold and the nature and geographical location of the markets to be served, as well as the transport and distribution costs of LNG from the point of export to the market are acceptable to Petrobangla.

১০.৫। আন্তর্জাতিক বাজারে ২০০৮ এবং ২০০৯ সালের তেল, গ্যাস ও এলএনজি এর দাম (টেবিল-১) পর্যালোচনা করে বলা যায় যে অদূরভবিষ্যতে দরপত্রে অংশগ্রহণকারী আইওসিরা গ্যাস আবিষ্কার করতে সক্ষম হলে মডেল পিএসসি-২০০৮ এ উল্লেখিত সর্বোচ্চ গ্যাসের দামের দুই থেকে তিনগুণ দামে আবিস্কৃত গ্যাস রপ্তানির চুক্তি করতে পারবে। সেক্ষেত্রে উপরে বর্ণিত ১৫.৫.৫ ধারার শর্তে গ্যাস রপ্তানির অনুমতি দিতে পেট্রোবাংলা বাধ্য হবে।

Table 1: Price of Crude Oil & Heat Equivalent Price of Natural Gas, Onshore, Offshore NG, Int. Coal & Local Coal

Price of Crude Oil & NG-08.exl
Notes: 1 ton= 7.4 barrel, 1 litre= (1 ton/1000/0.85), $ 1= Tk. 70,
HV of Oil = (42.7 GJ/ton), HV of Gas = (0.986GJ/MCF), HV of Coal = (25.63GJ/ton)
Well Head Price of Onshore Gas = (0.75 x Heat Equivalent Price of Oil)
Well Head Price of Offshore Gas = (0.9375 x Heat Equivalent Price of Oi)
Local Coal Price=0.7xInternational Coal Price

10.6| Article 15.6(a) Contractor shall offer its share of Cost Recovery Gas and Profit Gas to Petrobangla, and Petrobangla shall undertake that it or its Affiliates will purchase the gas. The obligation shall not be diminished if additional reserves of Gas are discovered outside the Contract Area as long as Contractor is fulfilling its obligation to deliver Natural Gas from the Production Area. The contractual terms of purchase and sale of such marketable Natural Gas shall be negotiated with Petrobangla or its Affiliate prior to approval of the Development Plan and shall include the financial terms set out in Article 15.7.

15.6(b) If a written notice of a market outlet is not given by Petrobangla within six (6) months after the date of submission of the Evaluation Report as per Article 8.5, Contractor will be free to find a market outlet within Bangladesh. Petrobangla shall cooperate with Contractor to facilitate such sale.

15.6(c) Contractor has the option to sell Contractor’s share of Natural Gas in the domestic market to a third party, subject to Petrobangla’s right of first refusal.

১০.৭। পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান এনার্জি এন্ড পাওয়ারে তার স্বাক্ষাতকারে বলেছেন যে, পেট্রোবাংলা আইওসির গ্যাস কেনার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেই কেবলমাত্র তারা তৃতীয় পক্ষের কাছে গ্যাস বিক্রি করতে পারবে এবং/অথবা এলএনজি করে রপ্তানি করতে পারবে। তার এ ব্যাখ্যাটি একান্তভাবে অগ্রহণযোগ্য। কেননা প্রথম রাউন্ডের অধীনে স্বাক্ষরিত পিএসসি অনুসারে সরকার/পেট্রোবাংলা ইতোমধ্যে কেয়ার্নকে মগনামা থেকে গ্যাস অন্বেষণ ও উত্তোলনের অনুমতি প্রদান করেছে (নিউ এইজ: ৩০ আগষ্ট, ২০০৯)। এ ক্ষেত্রে অদূর ভবিষ্যতে কাফকো এবং কোরিয়ান ইপিজেড স্বাচ্ছন্দ্যে কেয়ার্নের নিকট থেকে প্রতি এমসিএফ গ্যাস ৭-৮ ডলারে ক্রয়ের চুক্তি করতে আগ্রহী হবে, যার ফলে পেট্রোবাংলা তথা বাংলাদেশ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। অন্যদিকে কেয়ার্ন বিদ্যমান পিএসসি চুক্তির বাইরে প্রতি এমসিএফ গ্যাসের দাম ৩ ডলারের পরিবর্তে ৭-৮ ডলাবে বিক্রি করে লাভবান হবে। একথা সহজেই অনুমান করা যায় যে আলোচিত ৩টি ব্লকের ক্ষেত্রেও সরকার/পেট্রোবাংলা একটি অযুহাত সৃষ্টি করে গ্যাস রপ্তানির অনুমতি প্রদান করবে। জনগণের বিপুল ভোটে নির্বাচিত মহজোট সরকারের কাছ থেকে এধরনের একটি গণবিরোধী সিদ্ধান্ত কোনমতেই কাম্য নয়।

10.8| Article 15.7 The financial terms to be included in the purchase and sale agreement referred to in Article 15.6 shall be as follows:

(i) The price of Natural Gas shall be calculated as follows:

(a) subject to Article 15.7(ii), for onshore gas, the price shall be seventy-five percent (75%) of the Market Price as defined in Article 15.7(i)(b) converted into Dollars per mscf on the basis of thermal energy equivalents (BTU);

(b) the Market Price shall be calculated for each Calendar Quarter based on the arithmetic average of Asian Petroleum Price Index (“APPI”) quotations of High Sulphur Fuel Oil 180 CST (“HSFO”), FOB, Singapore only for such days as such quotations are published for the six months ending on the last day of the second (2nd) month preceding the start of the quarter for which the calculation of the Market Price is to be made; Such fuel oil price will have a floor of seventy Dollars ($70) per metric ton and a ceiling of one hundred and eighty Dollars ($180) per metric ton;

(c) in the event that the trading of HSFO in the area covered by APPI ceases or HSFO prices cease to be quoted by APPI ceases to be published, the Parties shall meet and agree as soon as possible upon a suitable alternative. Until such time as a new basis of pricing is agreed, the last available Marker Price shall continue to be used;

(d) for the western zone (Onshore) gas price shall be twenty-five percent (25%) higher than for the other onshore gas price calculated as per 15.7(i)(a).

or

for offshore gas from Type-A blocks situated north of 20 degree north latitude, the price shall be twenty-five percent (25%) higher than for the onshore gas price calculated as per (a) above;

or

for offshore gas from Type-b blocks situated south of 20 degree north latitude, the price shall be one hundred percent (100%) of the Market Price as defined in Article 15.7(i)(b);

(e) Petrobangla shall receive a discount of minimum one percent (1.%) on the price of gas calculated as per Article 15.7 (i)(a) and 15.7 (i)(d) on the Natural Gas sold by Contractor to Petrobangla at the Measurement Point.

(ii) Should the Marker Price for any Calendar Quarter, calculated as in Article 15.7(i)(d) above fall below a floor price of seventy Dollars ($70) per metric ton of HSFO or rise above a ceiling price of one hundred and eighty Dollar ($180) per metric ton of HSFO, the Marker Price for that quarter shall be fixed at the floorprice or ceiling price respectively.

(iii) The gas prices calculated in Articles 15.7 (i)(a), (i)(b), (i)(c), (i)(d) and (i)(e), above shall be applicable to sales at the Measurement Point.

(iv) Sales of Gas to Petrobangla or its Affiliate shall be invoiced monthly and payment shall be made within sixty (60) days of issue of invoice. The invoice should be supported by necessary documents along with “Cost Recovery Statement” as on the invoiced month.

10.9| 15.8 The price for Natural Gas sold to a third party(ies) shall be equal to the price obtained as per Article 15.7 or more.

১০.১০। ১৫.৭ ধারা বর্ণিত বিভিন্ন হিসাব অনুসারে মডেল পিএসসি-২০০৮ এ বর্ণিত উৎপাদিত গ্যাসের মূল্য নিম্নে উপস্থাপন করা হলো (Table 2)।

Table 2: Price of Onshore, West Zone, Offshore(A) and Offshore(B) Gas as per PSC-2008

১০.১১। আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রড ওয়েল এর দাম উঠা-নামা করলে ফুয়েল ওয়েলের দামও পরিবর্তীত হয়। তাপানুপাতিক হিসাব অনুসারে ক্রড ওয়েলের দাম (প্রতি ব্যারেল, প্রতি টন, প্রতি লিটার) এবং হিসাবকৃত প্রতি এমসিএফ Onshore Gas, Offshore(A) Gas/West Zone Gas Ges Off-shore(B) Gas এর দাম, কয়লার দাম (প্রতি টন) তুলনা করার জন্য Table ১: এ উপস্থাপন করা হয়েছে।

১১। মডেল পিএসসি-২০০৮ এ বর্ণিত সূত্র অনুসারে [১৫.৭(i) (b)] গ্যাসের সর্বোচ্চ মূল্য (তাপানুপাতিক হিসাবে) প্রতি টন ফুয়েল ওয়েল ১৮০ ডলার (প্রতি ব্যারেল ২৪.৩ ডলার) ধরে হিসাব করতে হবে। সে অনুসারে গভীর সমুদ্রাঞ্চলে উৎপাদিত প্রতি এমসিএফ গ্যাসের সর্বোচ্চ মূল্য হয় ৪.১৫৭ ডলার হয় (টেবিল-১)। ২০০৮ সালে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের সর্বোচ্চ মূল্য প্রতি ব্যারেল ১৪০ ডলার হয়েছিল। ২০০৯ সালে তেলের মূল্য প্রতি ব্যারেল ৭০ ডলারের কাছাকাছি আছে। প্রতি ব্যারেল তেলের মূল্য ৭০ ডলার এবং ১৪০ ডলার হিসাবে প্রতি এমসিএফ গ্যাসের দাম হয় যথাক্রমে ১১.৯৬১ ডলার এবং ২৩.৯২৩ ডলার (টেবিল-২)। এমতাবস্থায় সমুদ্রাঞ্চলে দরপত্রে অংশগ্রহণকারী আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানী ভবিষ্যতে দীর্ঘমেয়াদী বিক্রয় চুক্তির অধীনে উৎপাদিত প্রতি এমসিএফ গ্যাস ১০-১২ ডলারে চুক্তি করতে সক্ষম হবে। যা কিনা পিএসসিতে নির্ধারিত সর্বোচ্চ গ্যাসের দাম (প্রতি এমসিএফ ৪.১৬ ডলার) এর তিন গুন। এমতাবস্থায় পেট্রোবাংলা কোনভাবেই গ্যাস রপ্তানির এধরণের লাভজনক প্রস্তাব অনুমোদনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারবে না। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে সেপ্টেম্বর, ২০০৮ মাসে পেট্রোবাংলার অধীনস্ত বাখরাবাদ গ্যাস কোম্পানী আন্তর্জাতিক বাজারে ইউরিয়া সারের দামের সূত্রের হিসাব অনুসারে প্রতি এমসিএফ গ্যাস বিক্রি করে কাফকোর কাছ থেকে ১০.৯৫ ডলার পেয়েছে। সংবাদপত্রের খবরে প্রকাশ যে পেট্রোবাংলা পিএসসিতে বর্ণিত শর্ত ভঙ্গ করে কেয়ার্ন-কে উচ্চ দামে তৃতীয় পক্ষের কাছে গ্যাস বিক্রির অনুমতি প্রদান করেছে (নিউ এইজ: ৩০ আগষ্ট, ২০০৯)।

১২। পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান সাংবাদিকদের বলেছেন যে, মডেল পিএসসি ১৯৯৭-তে ছিল বিধায় পুনরায় মডেল পিএসসি ২০০৮-এ এলএনজি করে গ্যাস রপ্তানির সুযোগ রাখা হয়েছে। স্পষ্টত: পেট্রোবাংলা ১৯৯৭ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত সময়কালে দেশে গ্যাসের ক্রমবর্ধমান চাহিদা বৃদ্ধির ধরণ এবং দেশের অর্থনীতিতে গ্যাস ব্যবহারের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেনি। ১৯৯৭ সালে মোট উৎপাদিত গ্যাসের পরিমাণ ছিল ২৬১ বিসিএফ। যা ২০০৯ সালে বৃদ্ধি পেয়ে ৬৫৪ বিসিএফ হয়েছে। ১৯৯৭-২০০৯ সময় কালে গ্যাসের বাৎসরিক চাহিদা বৃদ্ধির গড় আয় ছিল ১২.৫%। ২০০৯ সালের জুলাই মাসে মোট গ্যাস উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ১৯৪৫ মিলিয়ন ঘনফুট সে তুলনায় গ্যাসের দৈনিক চাহিদা ছিল ২১৮০ মিলিয়ন ঘনফুট। অর্থাৎ দৈনিক মোট রেজিষ্টার্ড ঘাটতি ছিল ২৩৫ মিলিয়ন ঘনফুট, যা কিনা মোট উৎপাদন ক্ষমতার অতিরিক্ত ১২%। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থিত শিল্প-কারখানার গ্যাসের চাহিদা হিসাব করলে ২০০৯ সালের জুলাই মাসে গ্যাসের ঘাটতির মাত্রা মোট উৎপাদন ক্ষমতার ২৫% এর কম হবে না। অর্থাৎ গ্যাসের দৈনিক মোট চাহিদা হবে প্রায় ২৪৩১ মিলিয়ন ঘনফুট।

১৩। উপরের আলোচনা থেকে উপসংহারে বলা যায় যে, মহাজোট সরকার ৮০ ভাগ গ্যাস রপ্তানির সুযোগ প্রদান করে সমুদ্রাঞ্চলের ৩টি ব্লকের পিএসসি অনুমোদন করে একটি বাংলাদেশের তেল, গ্যাস অন্বেষণে একটি কালো অধ্যায়ের সূচনা করল। যার ফলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের অবস্থা নাইজেরিয়ার ন্যায় হতে পারে।

* তেল, গ্যাস খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি কর্তৃক ৩১ আগষ্ট, ২০০৯ তারিখে বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির মৈত্রী মিলনায়তনে আয়োজিত ”বহুজাতিক পুঁজি, অসম চুক্তি এবং বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা” শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে উপস্থাপিত মূল প্রবন্ধ।

 

References:

Alam, Nurul (2002): Petroleum Law, Aligarh Library, Dhaka New Market, Dhaka-1205, December 2002.

GOB (1993): Petroleum Policy 1993, Ministry of Energy and Mineral Resources, Govenment of the People’s Repubil of Bangladesh, 1993.

GOB (1996): National Energy Policy 1996, Banglaesh Gazette, 15 January, 1996.

Petrobangla (1997): Model Production Sharing Contract-1997, Petrobangla, 3 Kawran Bazar, Dhaka-1215, March 1997.

GOB (1998): The Constitution of the People’s Repubil of Bangladesh (As modified up to 31 December, 1998), Ministry of Law, Justice and Parliamentary Affairs, Govenment of the People’s Repubil of Bangladesh, 1998.

Islam M. Nurul (2001): R¡vjvwb mgm¨v evsjv‡`k †cÖw¶Z, MYcÖKvkbx, kvnevM, XvKv, 2001

মোঃ নুরুল ইসলাম (২০০৫): বাংলাদেশের জ্বালানি উন্নয়ন: সমকারীণ আলোচনা ও মতামত, ডক্টর ইঞ্জিনিয়ার গোলাম মহিউদ্দিন মেমোরিয়াল বক্তৃতা, দি ইনষ্টিটিউশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ, ৪৯তম জাতীয় কনভেনশন, চট্রগ্রাম, ১৫ মে ২০০৫।

Petrobangla (2008): Model Production Sharing Contract-2008, Petrobangla, 3 Kawran Bazar, Dhaka-1215, 2008.

Petrobangla (2008): Petroleum Exploration Opportunities in Bangladesh, Petrobangla, 3 Kawran Bazar, Dhaka-1215, 2008. February 2008.

Petrobangla (2008): Annual Report 2007, Petrobangla, 3 Kawran Bazar, Dhaka-1215, 2008. December 2008.

http://www.petrobangla.org.bd

মোঃ নুরুল ইসলাম (২০০৯): পিএসসিতে ৮০ভাগ রপ্তানির সুযোগ দেশের স্বার্থ বিরোধী, প্রথম আলো, ৭ জুলাই ২০০৯।

মোঃ নুরুল ইসলাম (২০০৯): তেল গ্যাস কয়লা রপ্তানি নিষিদ্ধ করে আইন পাস করা উচিত, ”সাপ্তাহিক” ১০ জুলাই ২০০৯।

মোঃ নুরুল ইসলাম (২০০৯): তিনটি গ্যাক্ষেত্র ইজারার সিদ্ধান্ত দেশের স্বাথ্যের পরিপন্থী, সাপ্তাহিক একতা, ৩০ আগষ্ট, ২০০৯।

Aminul Islam (2009): Cairn to Explore Magnama as Govt Bows to Pressure- allowing cairn to sale gas to third parties against country’s interest, say expert; The New Age, 30 August, 2009.

Sharier Khan (2009): PM Weighs in to Check Chevron Deal- Ask Petrobangla to Explain Why open tender for GTCL Project cancelled; The Daily Star, 30 August, 2009.

লেখকঃ

প্রফেসর মোঃ নুরুল ইসলাম
ইনষ্টিটিউট অব এপ্রোপ্রিয়েট টেকনোলজী
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
email: nurul@iat.buet.ac.bd

 প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলন ও অনুসন্ধানে আন্তর্জাতিকভাবে এক প্রশ্নবিদ্ধ নাম  ‘কনোকোফিলিপস’

গত ১৬ জুন বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রে ১০-১১ নম্বর গ্যাস ব্লকের গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন বিষয়ক এক অতি গুরূত্বপূর্ণ চুক্তি সম্পাদিত হয়। বাংলাদেশের  প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণকারী রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলা ও মার্কিন প্রতিষ্ঠান কনোকোফিলিপসের মধ্যে। মডেল পিএসসি ২০০৮ এর আলোকে চুক্তিটি সম্পাদিত হয়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে আলোচনায় উঠে আসে মার্কিন প্রতিষ্ঠান কনোকোফলিপস। কানাডিয়ান প্রতিষ্ঠান ‘নাইকো’ ও মার্কিন ‘অক্সিডেন্টাল’ দ্বারা দুটি ভয়াবহ দূর্ঘটনার পরে প্রশ্ন ওঠে বিদেশী প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা ও আন্তরিকতা নিয়ে। প্রাসঙ্গিকভাবেই সে প্রশ্নের আলোকে কনোকোফিলিপ্সের হাতে আমাদের সমুদ্রের গ্যাস ব্লকের নিরাপত্তা কতখানি তার সুরাহা করা দরকার। কনোকোফিলিপসের নামক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানটির বিগতদিনের কিছু ঘটনাচিত্র তুলে ধরা হল।

২০০২ সালে কনোকো ইনকর্পোরেটেড ও ফিলিপস  পেট্রোলিয়াম কোম্পানী একত্রিত হয়ে গঠন করে কনোকোফিলিপস কোম্পানী। এর সদর দপ্তর অবস্থিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যে। এই প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে পৃথিবীর ৩০টির বেশি দেশে প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ করছে। নিজেদের ওয়েবসাইটে তারা দাবি করছে ,এই মূহূর্তে তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় বৃহত্তম পেট্রোলিয়াম আহরণ ও পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠান।

তাদের ওয়েবসাইটে বিপুল দক্ষতা অভিজ্ঞতার বিবরণ থাকলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশ বিষয়ক কতৃপক্ষ বলছে ভিন্ন কথা।  ২০০৭ সালের মাঝামাঝি থেকে ২০১০ এর শুরু পর্যন্ত সময়টুকুতে যুক্তরাষ্ট্রের অকুপেশনাল সেফটি এন্ড হেলথ এডমিনিষ্ট্রেশান (ওএসএইচএ ) কর্তৃক ১১৮ বার পরিবেশ ও স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তা ভঙ্গ করার অভিযোগের নোটিশ পায় কনোকো ফিলিপস। এছাড়াও ছোট বড় বিভিন্ন মাপের বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য দূর্ঘটনা ঘটেছে কনোকোফিলিপসের গাফিলতিতে।

 

 

২০১১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারী

যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনের বেলিংহামে ভয়ঙ্কর বিষাক্ত গ্যাস নির্গমন

 

Figure 1রিফাইনারি থেকে বিষাক্ত গ্যাস ছড়িয়ে পড়ছে আকাশে

 

 

 

Figure 2রিফাইনারি থেকে বিষাক্ত গ্যাস ছড়িয়ে পড়ছে  পুরো শহরে

 

বেলিং হাম শহরে মোট এক লক্ষ সত্তুর হাজার মানুষের বাস। ফেব্রুয়ারির ২৪ তারিখ সেখানকার বাসিন্দারা হঠাত আবিষ্কার করলেন তাদের শহরের মাঝে অবস্থিত কনোকোফিলিপসের তেল শোধনাগার থেকে নির্গত হচ্ছে ঘন ধোঁয়া। কিছুক্ষনের মাঝে শুরু হল শ্বাসকষ্ট ও বুক জ্বালাপোড়া। ১০ মিনিটের মাঝে আকাশে ছড়িয়ে পড়ে ১,১০,০০০ পাউন্ড হাইড্রোফ্লুরিক এসিড। হাইড্রোক্লোরিক এসিড এমন এক বিপজ্জনক কেমিকেল যা সরাসরি মানুষের স্বাসযন্ত্রে আক্রমন করে এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে এর ফলে। দেখা গেল, বাতাসের গতিমুখে এই গ্যাস ধাবিত হয়ে ১৪ কিলোমিটার দূরের এলাকায় পর্যন্ত ক্ষতিসাধন করে। ওয়াশিংটনে শুধু  কনোকোফিলিপসের শোধনাগারেই এই গ্যাস ব্যবহার হয়। ওয়াশিংটনের পরিবেশকর্মীদের মতে হাইড্রোফ্লুরিক এসিড হল এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত সবচেয়ে বিষাক্ত রাসায়নিক যা শোধনাগারে ব্যবহার হচ্ছে। অত্যাধিক মুনাফার লোভে কনোকোফিলিপস এই রাসায়নিক আজো ব্যবহার করে চলেছে।

 

 

২০০৮ সালের ১১ নভেম্বর

কানাডার ডসন ক্রিকে পুড়িয়ে ফেলে গ্যাস কূপ

Figure 3 রিগ বিস্ফোরত হয়ে আগুন জ্বলছে

 

Figure 4 নিরুপায় কর্মীরা দেখছে গ্যাস কূপের বিস্ফোরিত হওয়া

ডসন ক্রিক থেকে ৪৫ কিলোমিটার পশ্চিমে প্রাকৃতিক গ্যাসের একটি কূপে কনোকোফিলিপ্স গ্যাস উত্তোলন করছিল। ১১ নভেম্বর ভোর হবার একটু আগে ৩টা ৫৫মিনিটে কূপে আগুন ধরে যায়। দূর্বল কূপটি গ্যাসের চাপ সহ্য করতে না পেরে একটু পরে পুরোপুরি বিস্ফোরিত হয়। টানা ১৩ দিন ধরে কূপটি দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে ঐ ঘটনার সময় বাতাসে প্রায় ২০০ রকমের রাসায়নিক পদার্থ ছড়িয়ে পড়ে যার অধিকাংশই স্বাহ্যের জন্য ক্ষতিকর।

কনোকো ফিলিপসের ভাইস প্রেসিডেন্ট স্বীকার করেন, ড্রিলিং এর সময় অতিরিক্ত তাপ উৎপন্ন হওয়ার ফলে এই দূর্ঘটনা ঘটে যা সহজেই এড়ানো যেত। তারা এটাও স্বীকার করে যে, তাদের প্রতিক্রিয়া ছিল অত্যন্ত ধীর।

 

২০০৮ সালের ২৫ ডিসেম্বর

আলাস্কার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় তেল ছিটিয়ে পড়ার ঘটনা

 

 

Figure 5পাইপলাইন ফেটে তেল ছড়িয়ে পড়েছে সাগরে

 

Figure 6 আলাস্কার কুপারুক তেলক্ষেত্র

ক্রিসমাসের দিন, আলাস্কার অন্যতম বৃহৎ তেলক্ষেত্রে কুপারুকে ঘটে গেল বিপর্যয়। জীর্ণ এবং ক্ষয় হয়ে যাওয়া পাইপলাইন ভেঙ্গে ৯৪ হাজার ৯২০ গ্যালন তেল ছড়িয়ে পড়ল সমুদ্রে। সমদ্রের পানিতে তেল মিশে যাওয়ার ফলে ভয়াবহ ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় আলাস্কার জীববৈচিত্র। পাইপলাইন সময়মতো মেরামত ও রক্ষনাবেক্ষনের অভাবে এই ঘটনা ঘটে।

 

২০০৭ সালের ৭ জুলাই

প্লাইমাউথের মেফ্লাওয়ার টার্মিনালে ট্যাঙ্ক ফেটে তেল ছিটিয়ে পড়লো

Figure 7 তেল রিজার্ভার

 

যুক্তরাজ্যের প্লাইমাউথ অঞ্চলের তেলের ভূগর্ভস্থ ট্যাঙ্কারে ফাটল থেকে ছড়িয়ে পড়ে ৮০ হাজারেরও বেশি লিটার পেট্রোল। পরিবেশে আদালতে এই ঘটনার ফলে কনোকোফলিপস জরিমানা দিতে বাধ্য হয় ৫০ লক্ষ টাকার বেশি মূল্যে। এই তেল মাটির নিচে ছড়িয়ে পড়ে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরে। ঐ এলাকায় পানি ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ে।

পরিবেশকর্মী সারাহ টেইলর দাবি করেন, ‘এই দূর্ঘটনা এড়ানো খুবই সম্ভব ছিল। খরচ বাঁচানোর জন্য তারা ট্যাঙ্কগুলো নিয়মিত পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে পরীক্ষা করে না। সঠিক রক্ষনাবেক্ষনের মাধ্যমে সহযেই এই দূর্ঘটনা এড়ানো যায়।‘

 

২০০৬ সালের ৩ মে

কানাডার এডসনের নিকটে গ্যাস কূপে বিস্ফোরণ

 

এই কূপের গ্যাসে অধিক পরিমানে হাইড্রোজেন সালফাইডের উপস্থিতি ছিল যা বিষাক্ত। এই বিষয়ে জানা থাকা সত্ত্বেও এই কূপে বিস্ফোরণ ঘটে এবং প্রায় দুই দিন ধরে আগুন জ্বলার পর তা নিয়ন্ত্রণে আসে।

 

২০০৪ সালের ১৩ অক্টোবর

যুক্তরাষ্ট্রের ডালকো প্যাসেজে তেল ছড়িয়ে পড়লো

 

 

Figure 8 সমুদ্রে তেল ছড়িয়ে পরেছে

 

Figure 9 সমুদ্রে তেল ছড়িয়ে পড়লে ধ্বংশ হয় প্রাণীকুল

 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডালকো প্যাসেজে ১০০০ গ্যালন তেল ছিটিয়ে পড়ায়  ৫ লক্ষ ৪০ হাজার মার্কি ডলার জরিমানা গুনতে হয় কনোকো ফিলিপসকে।

 

 

 

 

এছাড়াও  ২০০১ সালে কনোকো কম্পানী যুক্তরাজ্যের হাম্বার শোধনাগারে দূর্ঘটনা ঘটায়।১৬ এপ্রিলের এই ঘটনার ফলশ্রুতিতে এক মিলিয়নের অধিক পাউন্ড জরিমানা দেয় প্রতিষ্ঠানটি।

 

 

Figure 10 হাম্বার শোধনাগার জ্বলছে দাউ দাউ করে

২০০০ সালে ফিলিপস কর্পোরেশনের  প্যাসাডেনায় রেজিনের ট্যাঙ্কে আগুন লেগে চার জন গুরুতর আহত হওয়া সহ মোট ৬৫ জন কর্মী আহত হয়। কৃচ্ছতাসাধন করতে গিয়ে তারা ১১ বছরে তিনটি দূর্ঘটনা ঘটায়।

 

এরকম বহু ঘটনাই আমাদের চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। গভীর বিশ্বাসে বিদেশী কোম্পানীর হাতে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ছেড়ে দেয়া কতটুকূ বিবেচনার পরিচয় দেয়, তা গভীর পর্যালোচনার দাবি রাখে। বিদেশী কোম্পানী, বড় কোম্পানীগুলোকে যদি কেঊ ধোয়া তুলসীপাতা মনে করে থাকেন তাহলে আমাদের দেশ পড়তে পারে এক গভীর সংকটে।

 

মূল লিংকঃ http://on.fb.me/pIj4LU

আমাদের সাগরবক্ষের তিনটি গ্যাসব্লক যুক্তরাষ্ট্রের কনোকো ফিলিপস আর আইরিশ কোম্পানি টাল্লোকে ইজারা দেয়ার সময়ে আবারো শাসকগোষ্ঠী ও তার বংশবদ মিডিয়া-অর্থনীতিবিদ-বিদ্ধিজীবীরা সেই অতি পুরাতন কায়দায় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্সের বিরুদ্ধে নানারকম মিথ ছড়িয়ে যাচ্ছে। অতি পুরাতন কায়দায় ও সুচতুরভাবে। আদমজী ধ্বংসের সময়ে যা হয়েছে, রাষ্ট্রীয় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো প্রাইভেটাইজ তথা বন্ধ করার সময়ে যেসমস্ত প্রচারণা চালানো হয়, এবং আমাদের অনশোর গ্যাসক্ষেত্রগুলো অসম পিএসসি চুক্তির মাধ্যমে বিদেশীদের হাতে তুলে দেয়ার সময়েও আগেরবার পেট্রোবাংলা ও বাপেক্সকে নিয়ে যেরকম মিথ ছড়ানো হয়েছিল- এবারো তা শুরু হয়েছে। বাস্তবতার দোহাই দেয়া হচ্ছে, সফলতা/ব্যর্থতার খতিয়ান দেয়া হচ্ছে, নানা চটকদারি কথাও শোনাও যাচ্ছে। কিন্তু আমরা মনে করি এসবের মধ্য দিয়ে মূল সত্যটা সবসময়েই আড়ালেই থেকে যাচ্ছে, আড়াল করে রাখা হচ্ছে। বাস্তবতার দোহাই দিয়ে যা বলা হচ্ছে তা অনেকাংশে রংচং মাখিয়ে তিলকে তাল করা হচ্ছে- কখনো বা এই মুহুর্তের বাস্তবতাকে পূর্বতন কারণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে সবসময়ের বাস্তবতা হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে। আজ আমরা এরকম মিথের দিকেই দৃষ্টি দেয়ার চেস্টা করবো।

বাপেক্স/পেট্রোবাংলাকে নিয়ে যতসব মিথ
# পেট্রোবাংলা/বাপেক্স একটা অথর্ব প্রতিষ্ঠান
# এটা মাথাভারী প্রতিষ্ঠান
# এটার কোন এক্সপার্টিজ নাই, গ্যাস অনুসন্ধান বা উৎপাদন করার জন্য এদের দক্ষ লোকবল নেই-
# ৩৮ বছরে এরা কিছু করতে পারেনি- শুধু সীমাহীন দুর্নীতি ছাড়া
# মান্ধাতার আমলের যন্ত্রপাতি আর আমলা/কেরানী দিয়ে গ্যাস অনুসন্ধান সম্ভব?
# এদের চালাতে গিয়ে সরকারের প্রতিবছর কাড়ি কাড়ি টাকা লস হয়

…….. ইত্যাদি

প্রকৃত চিত্র ও বাস্তবতা
বাস্তবতা হচ্ছে, আমরা জাতিগতভাবে অনকে হীনমন্য- আমাদের হীনমন্য করে তোলা হয়েছে। আমরা অলস জাতি- আমরা দুর্নীতিবাজ- আমরা পিছিয়ে পড়া- আমরা অদক্ষ … ইত্যাদি শুনে শুনে আমরা অভ্যস্ত, আমাদের সফলতার চেয়েও আমাদের ব্যর্থতাগুলোর গল্প মিডিয়ায় গুরুত্ব পায়। বৃটিশ আমল থেকে শুনেছি- আমাদের শোনানো হয়েছিল, আমাদের জন্য বৃটিশ শাসন আশীর্বাদ কারণ বৃটিশরা সভ্য আর আমরা অসভ্য-নীচু জাতি, আমরা আমাদের শাসন করতে পারি না, পারবো না। বৃটিশ আমলের সেই প্রচারণা এখনও চালু- বৃটিশদের প্রেতাত্মা হয়ে এখনকার শাসকগোষ্ঠী নিষ্ঠার সাথে একই কাজ করে যাচ্ছে। তাই যেকোন মিথ নিয়ে আলোচনার আগে আমরা এই বাস্তবতার দিকেই সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। আজকের এই পরিসরে আমাদের সফলতার ফিরিস্তি দেয়া বা ব্যর্থতাগুলোর মূল কারণগুলো অনুসন্ধানের সুযোগ নেই, তবে পেট্রোবাংলা/বাপেক্সকে নিয়ে প্রচলিত এই সব মিথের জবাব দেয়ার চেষ্টা আমরা করবো। একটু পেছন থেকেই আমরা শুরু করছি:

বাপেক্সের সৃষ্টিই – একে দুর্বল করার লক্ষে
১৯৮৯ সালে বাপেক্সের সৃষ্টি হলেও এই প্রতিষ্ঠানটি পাকিস্তান আমলের OGDC (১৯৬২-১৯৭১) এবং বাংলাদেশের পেট্রোবাংলা (১৯৭১-৮৯) এর উত্তরসুরী (১)। ১৯৬২ সালে সোভিয়েত সহায়তায় OGDC প্রতিষ্ঠার পর থেকে পাকিস্তান আমলেই বাংলাদেশে গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম করে শুরু করে এবং ৪টি কুপ খনন করে সেমুতাং এ গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারও করে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে সাবেক OGDC এর জনবল, রিগ ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি নিয়ে দেশে “তৈল সন্দ্ধানী” নামে অনুসন্দ্ধাণ কোম্পানী সৃষ্টি করা হয় এবং মূলত এ কার্যক্রমকে দেখভাল করার জন্য পেট্রোবাংলা সৃস্টি করা হয়। সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে “তৈল সন্দ্ধানী”কে পেট্রোবাংলার সাথে একীভূত করা হয়। এর পর থেকে পেট্রোবাংলাই (এর এক্সপ্লোরেশন ডিরেক্টরেট) এই অনুসন্ধানের কাজ চালায়। ১৯৮৯ সালে বিশ্ব ব্যাংকের পরামর্শে পেট্রোবাংলা এর Exploration Directorate কে অবলুপ্ত করে বাপেক্স সৃস্টি করা হয় (২)। আপাত দৃষ্টিতে এ ব্যাবস্থা অনুসন্দ্ধান কার্যক্রমকে জোরদার করার উদ্যোগ মনে হলেও মূল উদ্দেশ্য ছিল ঠিক উল্টো। কোন আয়ের উৎসবিহীন বাপেক্স দ্রুত একটি উদ্যমহীন হতাশাগ্রস্থ প্রতিষ্ঠানে পরিনত হয়। শুরু থেকেই এর আর্থিক দিকসমূহ যেমন তার আয়- তার স্থায়ী খরচ, অনুসন্ধান ও খনন খরচ সবকিছুই দারুন অনিশ্চয়তার মাঝে পড়ে (৩)। একেকটা এক্সপেনডিচারের জন্য বরাদ্দ লম্বা প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাওয়ার কারণে বাপেক্সের কাজ হয়ে পড়ে দারুন মন্থর। বছরের শুরুতে ঘোষিত বরাদ্দটুকু যে কতদিনে আসবে তার কোন নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না- অসংখ্যবার সংশোধিত বাজেট হয়ে সেটা বাপেক্সের হাতে এসেছেও অনেক খর্বিত আকারে, কখনো কখনো দেখা এসেছে অর্থবছরের একদম শেষ সময়ে – খুব অল্প সময়ে তা সেই বরাদ্দটুকু খরচ করে ফেলার একটা তাগিদ সহকারে- এবং এভাবেই হাতে তুলে দেয়া হয়েছে দুর্নীতির সুযোগ। আর এই অনিশ্চয়তার মাঝে পড়ে সে সময় থেকে শুরু হয় বাপেক্সের দক্ষ লোকদের বাইরে চলে যাওয়া। সকলের হতাশা আরো বাড়িয়ে যখন ৯০ এর দশক জুড়ে ব্লকগুলো একের পর এক বিদেশী কোম্পানিদের হাতে তুলে দেয়া হয়- তখন বুঝা যায় বাপেক্সকে এমন ঠুটো জগন্নাথ বানানোর প্রচেস্টার মূল উদ্দেশ্য।

এর মধ্যে অবশ্য বাপেক্সকে একটু সাবলম্বী করার চেষ্টাও হয়। ১৯৯৪ সালে গ্যাস বাজারজাতে নিয়োজিত কোম্পানীগুলোর আয়ের ২% বাপেক্সকে দেয়ার বিধান হয়। কিন্তু সেটা অপ্রতুল বিবেচনায় বাপেক্সকে প্রোডাকশনের কাজও দেয়া হয়। কিন্তু সেই গ্যাস উৎপাদনে নামতে নামতে এরই মধ্যে পেরিয়ে গয়েছে ১১ টি বছর- ২০০০ সাল থেকে বাপেক্স গ্যাস উৎপাদন শুরু করে (৪)। এর মধ্যে যা ক্ষতি হওয়ার তা হয়েই গিয়েছে!

পরবর্তী আলোচনায় যাওয়ার আগে আমাদের এই ইতিহাস আলোচনা করে রাখার উদ্দেশ্য, এই প্রেক্ষাপট আমাদের মনে রাখার দরকার। বাপেক্স/পেট্রোবাংলা কি করতে পেরেছে, সেই আলোচনায় যাবার আগে- আরো দু একটি এদের সাথে কেমন আচরণ করা হয়েছে ও এখনও হচ্ছে- তার কিছু চিত্র দেখে নেয়া যাক।

অপারেশন ক্যাপাবিলিটি স্ট্রেনদেনিং প্রকল্প (৫)
এই বাহারি নামের প্রকল্পটি আসলে বাপেক্সের জন্য অত্যাবশ্যক হওয়া একটা রিগ কেনার প্রকল্পের নাম। মান্ধাতার আমলের যন্ত্রপাতি দিয়ে কাজ করে বাপেক্স- এটা আজ আমরা সকলেই জানি। এটার সমাধান যে নতুন যন্ত্র কেনা- পুরাতন জীর্ণ শীর্ণ যন্ত্র মেরামত করা, সেটা কারো মনে থাকে না বা বলা হয় না: উল্টো এটাই হয়ে যায় বিদেশীদের হাতে গ্যাসক্ষেত্রগুলো তুলে দেয়ার মোক্ষম যুক্তি!

১৯৯৮ সালেই বাপেক্স অনুভব করেছে তার একটি নতুন রিগ দরকার। সে সময়েই এটা বাপেক্স বোর্ড কর্ত্বক অনুমোদিতও হয়। তারপরে ১৯৯৯ সালে পেট্রোবাংলা বোর্ডও এটা অনুমোদন করে, একই বছরে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগও অনুমোদন করে। কিন্তু সেটা একনেক এ পাশ হতে সময় লাগে আরো ৪টি বছর, ২০০৩ সালে। এখানেই গল্পের শেষ নয়, বলা যায় শুরু। একনেকে ৮১ কোটি টাকা অনুমোদিত হলেও দেখা গেল ততদিনে রিগের আন্তর্জাতিক বাজারদর অনেক বেড়েছে এবং দরপত্রে অংশ নেয়া সর্বনিম্ন দাম ৩১% বেশী, অর্থাৎ ১০৬ কোটি টাকা। ফলে টেণ্ডার বাতিল হয়ে যায় এবং আবার সেটা দাম পুনর্মূল্যায়নের জন্য পাঠানো হয়। ১ম সংশোধিত বাজেট (১৪২ কোটি টাকা) আবার একনেক এ অনুমোদিত হতে হতে পার হয়ে যায় ২০০৬ সাল, এবং যথারীতি এবারেও আমরা টেণ্ডার মিস করি। এভাবে আরো কয়েকবার দরপত্র আহবান করে ও বাতিল করে অবশেষে পঞ্চমবারে ২৫৬ কোটি টাকা সংশোধিত বাজেট সহ ২০০৮ সালের নভেম্বরে দরপত্র আহবান করা হয় এবং ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে একটি চাইনিজ কোম্পানির সাথে চুক্তি সম্পাদিত হয়। রিগটি দেশে এসে অপারেশনে যাওয়ার কথা ২০১১ সাল।

৯৮ সালেই বর্তমান রিগগুলো (৩ টি রিগ) জীর্ণ-শীর্ণ হয়ে যাওয়ার পরেও এখন পর্যন্ত সেগুলোই বাপেক্সের সম্বল!

এক্সপ্লোরেশন এণ্ড প্রোডাকশন ক্যাপাসিটি বিল্ডিং অব বাপেক্স প্রকল্প (৭)
এটা আরেকটি বাহারি নামের প্রকল্প, শুনলেই মনে হয় বাপেক্সকে নিয়ে যেনবা কতই না সকলের আগ্রহ- একে আধুনিক ও দক্ষ প্রতিষ্ঠান বানাতে সকলের কতই না উদ্যোগ! অথচ একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে- এখানেও মজার একটি খেলা আছে। প্রকল্পের নাম বাপেক্সের ক্যাপাসিটি বিল্ডিং, কিন্তু একনেক এ অনুমোদিত প্রকল্প বরাদ্দ পুরোটাই কেবল বাপেক্সের জন্য নয়, পেট্রাবাংলারই আরেক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বিজিএসএল। বাখরাবাদ গ্যাস সাপ্লাই লি ৬৫ কি:মি: পাইপ লাইন বসাবে- সেই প্রকল্পের নাম কেমন করে বাপেক্সের ক্যাপাসিটি বিল্ডিং হতে পারে। ফলে- এটা অন্তত পরিষ্কার যে- এই প্রকল্পের জন্য অনুমোদিত ৩৪০ কোটি টাকার পুরোটা বাপেক্সের জন্য নয়। বাপেক্সের অংশ হচ্ছে ২০০ কোটি টাকা।

তো খুব ভালো, এই ২০০ কোটি টাকাতেও বাপেক্সে সিসমিক ডাটা একুইজিশন সিস্টেম কিনতে পারবে, একটি ওয়ার্ক ওভার রিগ কিনতে পারবে, অনুসন্ধান সাপোর্ট ইকুয়েপমেন্ট কিনতে পারবে, দক্ষতা বাড়ানোর জন্য ট্রেনিং এর আয়োজন করা যাবে। খুবই ভালো, এগুলোই প্রকল্পের উদ্দেশ্য হিসাবে বলা হয়েছে। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে- প্রকল্পের বাস্তবায়নকাল জুলাই ২০০৮ থেকে জুন ২০১১ সাল পর্যন্ত ধরা হলেও জুন ২০০৯ সাল পর্যন্ত বরাদ্দ এসেছে মাত্র ৪৫ লক্ষ টাকা (বাপেক্স ও বাখরাবাদ অংশ মিলিতভাবে)।

শ্রীকাইল প্রকল্প
২০০৪ সালে বাপেক্সের খনন করা এই অনুসন্ধান কূপটি পেট্রোবাংলার ওয়েবসাইটে দেয়া তালিকায় গ্যাস আবিষ্কার হিসাবে দেখানো হয়েছে। অথচ, অন্য সমস্ত জায়গায় বাপেক্স-পেট্রোবাংলার আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্রের সংখ্যা বলা হয় ৮ টি, যেখানে শ্রীকাইল গ্যাসক্ষেত্রের কোন নাম গন্ধই মেলে না। এখনই অবাক হবেন না, বা মনে করবেন না যে দুটি তথ্যের কোন একটি ভুল। আসলে দুটিই সত্য। শ্রীকাইল কূপটি খনন করে সেখানে গ্যাস পাওয়ার সমস্ত অনুষঙ্গ মিলেছিল বলেই সেটাকে গ্যাস আবিষ্কার ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছিল পেট্রোবাংলা। কিন্তু পরবর্তীতে কূপ দিয়ে পানি আসায় সেটাকে বাতিল করা হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে গ্যাস পাওয়ার ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হওয়ার পরেও সেখানে এখন পর্যন্ত বাপেক্স পরবর্তী কূপ খননের জন্য কোন উদ্যোগ নেয়নি এবং সেটাকে গ্যাসক্ষেত্র হিসাবে ঘোষণাও করা হয়নি।

মূল কারণটা আসলে অন্যত্র। এই শ্রীকাইল ক্ষেত্রটি টাল্লোর একটি গ্যাসক্ষেত্র বাঙ্গোরার খুব কাছে, এবং কথিত আছে শ্রীকাইল ও বাঙ্গোরা নাকি একই গ্যাসক্ষেত্রের অন্তর্গত। সুতরাং কি আর করা! বাপেক্সের কাজই বন্ধ হয়ে যায়। আরেকটি অভিযোগের কথা শোনা যায়, সেটা হচ্ছে বাপেক্সের জিওলজিস্টরা কূপটি খননের জন্য ঠিক যে জায়গা চিহ্নিত করেছিল- সেখানে নাকি কূপটি খনন করা হয়নি!

আরো কিছু প্রকল্পের অনুমোদিত বরাদ্দ
মোবারকপুর, কাপাসিয়া, সুন্দলপুরে অনুসন্ধান কুপ খনন প্রকল্পগুলোর ঘটনাগুলোও একই রকম। একটি বললেই বাকিগুলোর সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে। ২০০১ সালে বাপেক্স বোর্ড মোবারকপুর প্রকল্প অনুমোদন করে পেট্রোবাংলায় পাঠায়, পেট্রোবাংলা এবং জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ বিভাগও একই বছরে অনুমোদন করে। তারপরে একনেক এ অনুমোদন পেতে পাতে ২০০৬ সাল। ৫৬ কোটি বরাদ্দ ধরা হয়, বাস্তবায়নকাল জানুয়ারি ২০০৬ থেকে জুন ২০০৯। খুবই মজার বিষয় হচ্ছে এ পর্যন্ত বরাদ্দ এসেছে ৩ কোটি ১১ লাখ টাকা (৭)!

আর বেশী চিত্র তুলে ধরার দরকার নেই- এরই মধ্যে আমাদের সামনে সমস্তকিছু পরিষ্কার হয়ে যাওয়ার কথা। কারণটা নাহয় বুঝা গেল- কেন বাপেক্সের এই অবস্থা। কিন্তু তাই বলে কি স্বীকার করে নিব যে বাপেক্স কিছুই করতে পারেনি? না- সেটাও স্বীকার করা যাচ্ছে না। বাপেক্সের প্রতি এমন আচরণের পরেও- বাপেক্স তার ভাঙ্গা-জীর্ণ-শীর্ণ যন্ত্রপাতি দিয়েই অনেক কিছু করেছে। তাহলে এবার সেটা দেখা যাক:

বাপেক্স কি কি করেছে:
প্রথমে ১৯৮৯ সালে বাপেক্স সৃষ্টির পরে থেকেই এর কাজগুলো দেখি।
বাপেক্স গঠনের পর থেকে ১৯৮৯ পরবর্তী সময়ে বিদেশী কোম্পানি ১৭ টা অনুসন্ধান কূপ খনন করে, বেশ কিছু গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কার করে (যেগুলোর সাম্ভাব্যতা আগেই পেট্রোবাংলা/বাপেক্স বের করেছিল), দুটো গ্যাসক্ষেত্র ধ্বংস করে ফেলে- আর এর বিপরীত বাপেক্সকে দেয়া হয় মাত্র হাতে গোনা কয়টি ক্ষেত্র, তার মধ্যেও বাপেক্স সালদানদী, শাহবাজপুর ও শ্রীকাইলে গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে। অনুসন্ধান কুপ খনন করে ৪ টি, যার ৩ টিতেই গ্যাস মিলে। অর্থাৎ সাফল্যের হার ১.৩৩:১ (৮)।

এর বাইরেও এ সময়ে বাপেক্স কিছু গুরুত্বপূর্ণ(!) কাজ করে। নাইকোর একটা কুপ (ফেনী-২) খনন করে দেয়, টাল্লোর হয়ে লালমাই ও বাঙ্গোরায় Well cellar survey’র কাজ করে, চাঁদপুরে Control Point ই স্থাপন করে দেয় (৯)। বাঙ্গোরায় টাল্লোর একটা কুপও (ওয়ার্ক ওভার) খনন করে দেয়। তারপরেও বলা হবে- বাপেক্স কি করেছে? আসলেই তো – বাপেক্স কি করেছে? ফেনী-২ কুপ খনন করে দিলেও তো সেটা বাপেক্সের কিছু না, টাল্লোর লালমাই-বাঙ্গোরা-চাঁদপুর তো আর বাপেক্সের নয়। এমনকি পেট্রোবাংলার আরেক সেলফ ফাইনান্সিং গ্যাস উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান BGFCL এর হবিগঞ্জ-৯ কুপ খনন করে দিলেও সেটা বাপেক্সের কিছু করা নয় (সেলফ ফাইনান্সিং BGFCL হবিগঞ্জ-৯ এর গ্যাস উত্তোলন ও বিক্রয় করে মুনাফা করতে পারলেও- ঐ কুপ খননের জন্য বাপেক্সকে সরকারের বরাদ্দের দিকে থাকতে হয় দীর্ঘ প্রতীক্ষায়!!)।

এখানে একটা হিসাব খুব গুরুত্বপূর্ণ। বাঙ্গোরায় টাল্লোর ওয়ার্ক ওভার কুপটি খননের জন্য বাপেক্স নেয় ১০ লাখ ডলার, যদিও বাপেক্সের খরচ হয় মাত্র ৫৩ লাখ টাকা। এরকম লাভে সাবকন্ট্রাক্টর হিসাবে কাজ করতে পারার ক্ষমতায় আমরা বহুত খুশী, কিন্তু যখন দেখি ঐ ১০ লাখ ডলার তো ঠিকই টাল্লো তার রিকভারি কস্টের মধ্যে দেখিয়ে আমাদের কাছ থেকেই আদায় করে নেয়, যখন ভাবি ঐ গ্যাসক্ষেত্র যদি বাপেক্সের হাতে থাকতো- তবে ১০ লাখ ডলারের বদলে ৫৩ লাখ টাকায় কাজটি করে ফেলতে পারতাম- এমনি করে সম্পূর্ণ প্রজেক্টই আমরা কত সহজে ও কম খরচে সমাধা করতে পারতাম- তখন কি আমাদের একটুও আফসোস হবে না?

বাপেক্স কি কি করেনি
বাপেক্স আমাদের দেশের একমাত্র গ্যাস অনুসন্ধানকারী প্রতিষ্ঠান, ফলে গ্যাস অনুসন্ধানের কাজই এর কাছ থেকে কাম্য। প্রতিষ্ঠার পর থেকে সেই কাজটি বাপেক্স ঠিকভাবে করেনি। করেনি না বলে বলা দরকার করতে পারেনি- করতে দেয়া হয়নি। আজ দেশে গ্যাস সংকটের কথা জোরেশোরে বলা হচ্ছে, গ্যাসের অভাবে সার কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যহত হচ্ছে, সাধের বিনিয়োগও নাকি হচ্ছে না। এ মুহুর্তে গ্যাসের ঘাটতি দৈনিক ২৫০মিলিয়ন কিউবিক ফুট, তারচেয়েও বড় সমস্যা আগামিতে আমাদের গ্যাসের মজুদ, আসলেই আমাদের জ্বালানি নিরাপত্তা অনিশ্চয়তার মুখে। অথচ দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এখনও প্রাথমিক অনুসন্ধানের কাজ শুরু করা হয়নি। গ্যাস সংকটের কথা বলে বিদেশীদের হাতে সমুদ্রব্লকগুলো দিয়ে দেয়ার আয়োজন হয়- কিন্তু বাপেক্সকে নিয়ে কার্যকর কোন উদ্যোগ নেয়া হয় না। বাপেক্স গঠনের পর থেকে অনুসন্ধান কূপ খনন করা হয় মাত্র ৪ টি, অথচ এসময়ে আইওসি অনুসন্ধান কূপ খনন করেছে ১৭ টি। ১৯৯৬ সালের পর থেকে গত ১৩ বছরে বাপেক্স কূপ খনন করেছে মাত্র ১ টি!

পেট্রোবাংলা/বাপেক্স কি করেছে?
ওজিডিসি, পেট্রোবাংলা ও বাপেক্স এ পর্যন্ত ১৮ টি অনুসন্ধান কুপ খনন করে ৮ টি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করেছে (১০)। সাফল্যের হার ২.২৫:১। যা বাংলাদেশ কর্মরত বিদেশী কোম্পানীর সাফল্যের হারের চেয়ে ভালো। ১৯১০ সাল থেকে এ পর্যন্ত দেশী বিদেশী কোম্পানি মিলে অনুসন্ধান কুপ খনন করেছে ৭৫ টি যার মধ্যে গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে ২৫ টি (১১)। সাফল্যের হার ৩:১।

এর বিপরীতে মাগুরছড়া ও টেংরাটিলার মত কোন দুর্ঘটনার উদাহরণ পেট্রোবাংলা/ বাপেক্সের নেই। সাংগু গ্যাস ফিল্ডের মত তড়িঘড়ি করে ক্যাপাসিটির বেশী গ্যাস উত্তোলন করতে গিয়ে রিকাভরেবল গ্যাস উত্তোলনের অনেক আগেই গ্যাসক্ষেত্রের উৎপাদনক্ষমতা নষ্ট করার ঘটনা পেট্রোবাংলা/বাপেক্সের নেই।

পেট্রোবাংলা নিয়মিতভাবে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে অর্থ যোগান দিয়ে যাচ্ছে।যেখানে ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরে এর পরিমাণ ১ হাজার ২শ কোটি টাকা, সেখানে ২০০৭-২০০৮ অর্থবছরে এর পরিমাণ ৩১৫০ কোটি টাকা এবং ২০০৮-২০০৯ অর্থবছরে এর পরিমাণ ৩৩৪৯ কোটি টাকা(১২), যার মধ্যে বাপেক্স দিয়েছে ৮২ কোটি টাকা (সবচেয়ে বেশী দিয়েছে বিজিএফসিএল- ১৪৩১ কোটি টাকা)। পেট্রোবাংলার গ্যাস উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সরকারকে প্রতি হাজার কিউবিক ফুট গ্যাস মাত্র ২৫ টাকায় দিতে পারে (মুনাফা রেখেই) – যেখানে বিদেশী কোম্পানির কাছ থেকে কিনতে খরচ হয় ২৫০ টাকা।

এমন চরম দুর্দশার মধ্যেও এই সাফল্যগুলোকে কি বলা যাবে?
আমাদের এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ে- এদের লোকবলের দক্ষতা নিয়ে কি আমরা গর্ববোধ করতে পারি না?

বাপেক্সকে শক্তিশালী করার জন্য আমাদের দাবী সমূহ:এটা খুবই পরিষ্কার বাপেক্সের যে- আজ যেমন দশা, যত সংকট তা সম্পূর্ণভাবে আরোপিত, শাসক গোষ্ঠীর তৈরী। আমাদের দেশের জ্বালানি নিরাপত্তার তাগিদেই আমাদের বাপেক্স ও পেট্রোবাংলাকে খুব সিরিয়াসলি দৃষ্টি দেয়া আবশ্যক হয়ে পড়েছে। সুতরাং বাপেক্সকে শক্তিশালী করা, একে আরো অনেক বেশী করে কার্যকর করে তোলা এখন সময়ের দাবি। এ লক্ষে আমাদের দাবিগুলো হচ্ছে:
১। ভবিষ্যতে দেশের অভ্যন্তরে এবং উপকূলে অবস্থিত ব্লকসমূহে অনুসন্ধান ও উৎপাদন কাজ শুধুমাত্র বাপেক্সের উপর ন্যাস্ত করতে হবে। সকল পিএসসি বাতিল করতে হবে।
২। বাপেক্সকে আরও দক্ষ ও শক্তিশালী করার দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহন করতে হবে যেন স্থল ভাগের মতো গভীর সমুদ্রেও দেশীয় কোম্পানীগুলো নিজেরাই তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলণ কার্য চালাতে পারে। মধ্যবর্তী সময়টুকুতে একটি বা দুটি ব্লক থেকে কাজ চালানোর মতো গ্যাস উত্তোলণের জন্য বাপেক্সের কর্তৃত্ত্বাধীনে দেশী-বিদেশী কন্ট্রাক্টর ও যন্ত্রপাতি ভাড়া করা যেতে
৩। বাপেক্সের জন্য প্রয়োজনীয় রিগ ও অন্যান্য সরঞ্জাম অবিলম্বে সরবরাহ করতে হবে।
৪। বাপেক্সের কারিগরি জনবলের দক্ষতা বৃদ্ধির নিমিত্তে দেশ-বিদেশে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা করতে হবে। কারিগরি জনবলকে উপযুক্ত মর্যাদা ও গুরুত্ব দিতে হবে।
৫। বাজেটে বাপেক্সের জন্য পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দিতে করতে হবে। এই বরাদ্দ একনেক এ অনুমোদন ও বাপেক্সকে প্রদানে অহেতুক সময় ক্ষেপন বন্ধ করতে হবে। বাপেক্স ও পেট্রোবাংলা তথা পেট্রোবাংলার প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব আয় সরাসরি বাপেক্স ও পেট্রোবাংলার অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর বিভিন্ন প্রকল্পে সরাসরি বরাদ্দ করার সুযোগ দিতে হবে।
৬। মূল সংস্থা পেট্রোবাংলাকে দক্ষ ও শক্তিশালী করতে হবে।
৭। গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদন নিয়ে সরকারের একটি সুনির্দিষ্ট ও সুদুরপ্রসারী পরিকল্পনা থাকতে হবে। বাপেক্সের অধীনে সমস্ত বাংলাদেশে জিওলজিকল সার্ভে কাজ সম্পন্ন করার একটা লক্ষমাত্রা ঠিক করতে হবে, বাপেক্সকে দিয়ে বছরে কতটি অনুসন্ধান কূপ খনন করানো হবে- তারও একটি লক্ষমাত্রা ঠিক করতে হবে। এ লক্ষমত্রা পূরণের জন্য প্রয়োজনীয় রিগ, যন্ত্রপাতি কিনতে হবে- অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে, লোকবল নিয়োগ ও তাদের দক্ষতা বাড়িয়ে তুলতে হবে। 

তথ্যসূত্র:
১। Click This Link
এবং http://www.petrobangla.org.bd/corp_history.php
২। Click This Link
৩। ঐ
৪। ঐ
৫। মাসিক অগ্রগতির প্রতিবেদন জুন ২০০৯, বাপেক্স ; পৃষ্ঠা: ০৩
এবং http://www.bapex.com.bd/more-2.html
৬। মাসিক অগ্রগতির প্রতিবেদন জুন ২০০৯, বাপেক্স; পৃষ্ঠা: ০৯-১০
7. ঐ; পৃষ্ঠা: ০৪
৮। Click This Link
৯। http://www.bapex.com.bd/achievement.html
১০। Click This Link
১১। Click This Link
১২ Click This Link

মূল লিংকঃ http://www.somewhereinblog.net/blog/dinmojurblog/29006844

সম্প্রতি মডেল পিএসসি ২০০৮ ও কনকোফিলিপসকে সমুদ্র ব্লক ইজারা দেয়ার শর্তগুলোকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে। প্রথমত, একজন সাধারণ পাঠকের কাছে পিএসসি একটি দুর্বোধ্য দলিল। দ্বিতীয়ত সাধারণ পাঠক যখন একেক জায়গায় একেক বিশ্লেষণ পড়েন তখন স্বাভাবিক কারণে তাদের মধ্যে নানারকম মতামত তৈরি হয়। ভিন্ন মতামত থাকা সমস্যাজনক নয়, কিন্তু সমস্যাজনক হচ্ছে ভুল তথ্যের ওপর নির্ভর করে জনমতকে প্রভাবিত করার চেষ্টা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব মতামত নিয়ন্ত্রিত হয় গণমাধ্যমে প্রচারণার মাধ্যমে। কিছু কিছু খবরের কাগজ পরিপূর্ণ তথ্য উপস্থাপন না করে আপাতদৃষ্টিতে নিরপেক্ষ অবস্থান প্রতিষ্ঠিত করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে।

তার নমুনা পাই আমরা যখন দেখি গণমাধ্যমগুলো বিভ্রান্তিকর তথ্য উপস্থাপন করে পাঠকদের মধ্যে অনেক প্রশ্নের উত্তর অমীমাংসিত রেখে দেয়। সাধারণ জনগণ যখন কিছুটা হলেও তথ্য খুঁজছে তখন গণমাধ্যমগুলো ভুল ও পরস্পরবিরোধী তথ্য-উপাত্ত হাজির করে জনগণকে আরো বিভ্রান্ত করে তুলছে। আমরা এই লেখাটিতে পিএসসির অন্তর্ভুক্ত কয়েকটি বিষয়কে তথ্য-উপাত্তসহ সহজভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করছি।

অংশীদারিত্ব 
গত ১৬ই জুনে স্বাক্ষরিত পিএসসি চুক্তির আওতায় কনকোফিলিপস কত ভাগ পাবে আর বাংলাদেশ কত ভাগ পাবে, সেটা নিয়ে বিভিন্ন রকম ধারণা দেয়া হয়েছে জনগণকে। জনগণ কী বুঝবে আর কী বুঝবে না, সেটা নিয়ে এক ধরনের দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। পেট্রোবাংলার প্রেসনোটে বাংলাদেশ লাভের গ্যাসের ৫৫% থেকে ৮০% পাবে বলে উল্লেখ থাকলেও সরকারের বিভিন্ন মহল এবং বিভিন্ন মিডিয়া মারফত প্রচারণা চালানো হচ্ছে, বাংলাদেশ নাকি পুরো গ্যাসের ৫৫% থেকে ৮০% পাবে! যেমন: ডেইলি স্টারের ২১ জুনের একটি রিপোর্টের শিরোনাম এবং ভেতরে দুইটি বাক্যে ‘লাভের গ্যাস’ কথাটি উল্লেখ না থাকায় এই খবরটি বিভ্রান্তি তৈরি করেছে। এই বিষয়টি ভালোমত বোঝার জন্য মডেল পিএসসিতে কী আছে, সেটা খতিয়ে দেখা যাক। মডেল পিএসসিতে উল্লেখ করা আছে উৎপাদিত মোট গ্যাসের ৫৫% কস্ট রিকভারি গ্যাস হিসেবে দাবি করতে পারবে কনকোফিলিপস এবং বাকি ৪৫% হলো লাভের গ্যাস বা প্রফিট গ্যাস, যা চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ ও কনোকোফিলিপসের মধ্যে ভাগাভাগি হবে। চুক্তির দিন পেট্রোবাংলার দেয়া প্রেসনোট থেকে দেখা যায় উত্তোলিত গ্যাসের পরিমাণভেদে লাভের গ্যাস থেকে বাংলাদেশ ৫৫% থেকে ৮০% পাবে। এখন লাভের গ্যাসের ৫৫% পাওয়ার মানে হলো মোট গ্যাসের ২৪.৭৫% পাওয়া, আর লাভের গ্যাসের ৮০% পাওয়া মানে মোট গ্যাসের ৩৬% পাওয়া। অথচ ‘Govt share up to 80pc’ শিরোনামে লেখা ডেইলি স্টারের রিপোর্টে লেখক প্রফিট গ্যাস কথাটি উল্লেখ না করে জনগণকে বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে দিয়েছেন।

এবার একটি চিত্রের মাধ্যমে দেখা যাক মডেল পিএসসিতে প্রাপ্ত তথ্য এবং সরকারি মহলের বক্তব্য একত্র করলে অংশীদারিত্ব কী রকম দাঁড়ায়। উল্লেখ্য, নিচে উল্লেখিত উৎপাদন বণ্টন শুধু কস্ট রিকভারি পর্যায়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

পিএসসি ২০০৮-এ আরো উল্লেখ আছে, ১০ বছরের আগে কোনোভাবেই পেট্রোবাংলা সর্বমোট বিপণনযোগ্য গ্যাসের ২০% -এর বেশি রাখতে পারবে না। ১o বছর পর পেট্রোবাংলা চাইলে সর্বোচ্চ ৩০% পর্যন্ত রাখতে পারে। নিচে পিএসসি ২০০৮-এর ১৫.৫.৪ অনুচ্ছেদটি দেয়া হলো

কস্ট রিকভারির রাজনৈতিক অর্থনীতি
গ্যাস উত্তোলনের সময়কে মূলত দুই ভাগে ভাগ করা যায়: ১. কস্ট রিকভারি পর্যায়, ২. প্রফিট পর্যায়। অংশীদারিত্ব প্রশ্ন অসম্পূর্ণ থেকে যায় কস্ট রিকভারির সময়সীমা নির্ধারণ ও এই সময়সীমাকে দীর্ঘায়িত করার পিছনের রাজনৈতিক অর্থনীতি বিবেচনা না করলে। অনেকেই বলার চেষ্টা করছেন, কোম্পানির খরচ উঠে গেলে কস্ট রিকভারি পর্যায় তো একসময় শেষ হয়ে যাবে, তখন তো পুরো উত্তোলিত গ্যাসই হয়ে যাবে লাভের গ্যাস, যার ৫৫% থেকে ৮০% বাংলাদেশ পাবে। প্রথম আলোয় প্রকাশিত ‘পিএসসি সহজ পাঠ’ শীর্ষক কলামে ম. তানিমও এরকম আশাবাদ রেখে বলেছেন, কস্ট রিকভারি পর্যায় শেষ হলে বাংলাদেশ লাভের গ্যাসের ৫৫ থেকে ৮০ শতাংশ ও সামগ্রিকভাবে উৎপাদিত গ্যাসের ৫০ শতাংশের বেশি পেতে পারে। আপাতদৃষ্টিতে এই ব্যাখ্যা আকর্ষণীয় মনে হলেও এর পেছনের ফাঁপা অনুমানটি সহজে সাধারণ পাঠকের চোখে নাও পড়তে পারে। এই অনুমানের ভিত্তি হলো বহুজাতিক কোম্পানির চরিত্র সম্পর্কে একটি ‘ইতিবাচক’ চিন্তা, যেই চিন্তা আমরা বেশিরভাগ সময় আমাদের নিজেদের সামর্থ্যের ব্যাপারে করতেও ব্যর্থ হই। অনুমানটি হলো, ‘কনকোফিলিপস দফায় দফায় তার খরচের হিসেব বাড়িয়ে দেখাবে না।’ কিন্তু বাস্তবে তা হয় কি না সেটা বুঝতে হলে আমাদের দেখতে হবে তেল-গ্যাস কোম্পানিগুলোর আগের নজির।

বাস্তবে তেল-গ্যাস কোম্পানিগুলো নানাভাবে কস্ট রিকভারি পর্যায়কে দীর্ঘায়িত করে। তারা বিনিয়োগকৃত অর্থ পরিমাণ অতিমাত্রায় বাড়িয়ে দেখায় এবং স্থাপিত যন্ত্রপাতি ও মেশিনপত্রের দাম বেশি দেখায়, পুরোনো মেশিনকে নতুন মেশিন হিসেবে চালিয়ে দেয়। নানা অপ্রয়োজনীয় খরচের হিসাব দাখিল করে। বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দেখিয়ে খরচ বাড়ায় আর এসব খরচ নিয়ন্ত্রণ, সঠিক খরচের হিসাব বের করা বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর পক্ষে করা সম্ভব হয় না; তারা আমলা-এজেন্ট-রাজনীতিবিদদের ঘুষ প্রদানের মাধ্যমে ক্রমবর্ধমান বাজেট দফায় দফায় পাশ করিয়ে নেয়। এ ধরনের খরচ দেখিয়ে কস্ট রিকভারি পর্যায় দীর্ঘায়িত করার বিভিন্ন নজির আছে, যা চুক্তির গোপনীয়তা রক্ষার নামে সাধারণত অপ্রকাশিতই থেকে যায়। এখানে দুটি নজির উল্লেখ করা যায়।

১. মাগুরছড়ায় অক্সিডেন্টাল ১৯৯৫ সালে সিসমিক সার্ভে এবং তিনটি কূপ খননের জন্য প্রথমে এক কোটি ৮৮ লাখ ডলারের হিসাব দিলেও ১৯৯৭ সাল নাগাদ চারবার সংশোধনের মাধ্যমে তা চার কোটি ৯১ লাখ ৪০ হাজার ডলারে পরিণত হয়। এবং এই খরচের হিসাব কূপখননের খরচের হিসাব ছাড়াই।

২. অগভীর সমুদ্রের সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্রে কেয়ার্নের কস্ট রিকভারির হিসাবটা দেখা যাক। বিডিংয়ের সময় ১০.৮১ মিলিয়ন ডলার প্রকল্প ব্যয় দেখানো হলেও একের পর এক সংশোধনী বাজেট দিয়ে শেষ পর্যন্ত ব্যয় দাঁড়ায় ৬৬০ মিলিয়ন ডলার। ফলে এই গ্যাসক্ষেত্র থেকে বাংলাদেশ মাত্র ২০ শতাংশ গ্যাস পায়।

পেট্রোবাংলার এপ্রিল মাসের এমআইএস রিপোর্ট থেকে দেখা যায়, এ বছরের এপ্রিলে মোট ১৩.৮৩৪ এমএমসিএম গ্যাসের মধ্যে কেয়ার্নের ভাগে পড়ে ১১.০৭৫ এমএমসিএম গ্যাস, অর্থাৎ বাংলাদেশের ভাগে পড়ে মাত্র ২.৭৫৯ এমএমসিএম, যা মোট গ্যাসের মাত্র ১৯.৯৪ শতাংশ।

ফলে যতই গ্যাস উত্তোলিত হউক, কস্ট রিকভারি পর্যায় আর শেষ হয় না। একের পর এক সংশোধনী বাজেটের মাধ্যমে ক্রমবর্ধমান কস্ট রিকভারি পর্যায় বহুজাতিক কোম্পারি জন্য হয়ে ওঠে বিপুল মুনাফা অর্জনের পর্যায়।

রফতানি
চুক্তিতে যে রফতানির সুযোগ রাখা হয়েছে সেটা সরকারও অস্বীকার করছে না; কিন্তু তারা বলছে, এই সুযোগ এমন একটি শর্তের অধীন রাখা হয়েছে যে কার্যত বহুজাতিক কোম্পানির পক্ষে রফতানি করা সম্ভব হবে না। শর্তটি হলো, প্রথমে পেট্রোবাংলার কাছে বিক্রির বাধ্যবাধকতা, উত্তোলিত গ্যাস পেট্রোবাংলা কিনতে রাজি না হলেই কেবল এলএনজি আকারে রফতানি করা যাবে। আসলেই কি এটা খুব কঠিন একটা শর্ত? কী করবে পেট্রোবাংলা যদি কনোকোফিলিপস পেট্রোবাংলা তথা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ প্রয়োজন ও ব্যবহার ক্ষমতার চেয়ে বেশি পরিমাণ গ্যাস উত্তোলন করতে শুরু করে? চুক্তিতে বছরে মোট উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের ৭.৫% হারে উত্তোলনের সুযোগ রাখা হয়েছে এবং প্রয়োজনে সমুদ্রের গ্যাসের ক্ষেত্রে এই হার আরো বাড়িয়ে নেয়ারও সুযোগ রেখে দেয়া হয়েছে। সমুদ্রে বড় গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার হলে তো এরকম একটা পরিস্থিতি তৈরি হওয়া খুবই স্বাভাবিক। বিশেষ করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে পেট্রোবাংলার কাছে গ্যাস বিক্রি করলে কোম্পানিকে যেহেতু প্রতিহাজার ঘনফুট গ্যাসের দাম সর্বোচ্চ ৪.৩৫ ডলার নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে, যেখানে বিদেশের বাজারে রফতানি করতে পারলে ১০-১২ ডলার দামে বিক্রি করা যাবে। বাংলাদেশ নিজে গ্যাস উৎপাদন করলে এর চেয়ে বহুগুণ কম খরচে গ্যাস উত্তোলন করতে পারত বলে এভাবে ৪.৩৫ ডলার হারে বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে গ্যাস কেনাটা বাংলাদেশের জন্য বিপুল ক্ষতি সন্দেহ নেই, কিন্তু বাংলাদেশের বাজারের এই হার আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় প্রায় ৩ গুণ কম বলে এক অর্থে এই রেটে গ্যাস বিক্রি করা বহুজাতিক কোম্পানির জন্য ‘লস’। ফলে স্বাভাবিকভাবেই কোম্পানি ছলে-বলে-কৌশলে নানাভাবে চাইবে দেশের বাইরে গ্যাস রফতানির পরিস্থিতি তৈরি করতে। তাহলে কেন চুক্তিতে সোজা বলে দেয়া হলো না—বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ প্রয়োজনের সাথে সঙ্গতি রেখেই গ্যাস উত্তোলন করতে হবে? কেন সরাসরি রফতানি নিষিদ্ধ করা হলো না?

বাংলাদেশের ভর্তুকি, বহুজাতিকের মুনাফা
তর্কের খাতিরে যদি ধরি, গ্যাস রফতানি হলো না, সেক্ষেত্রেও এই ধরনের চুক্তির ফলে আমাদেরকে নিজেদের গ্যাস বিদেশী কোম্পানির কাছ থেকে প্রবাসী ও গার্মেন্ট শ্রমিকদের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে বাড়তি দামে কিনতে হবে। বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্য স্থলভাগের গ্যাস কেনার উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। স্থলভাগে প্রচলিত পিএসসি চুক্তি অনুসারে বিদেশী কোম্পানির কাছ থেকে বাংলাদেশকে গড়ে প্রতিহাজার ঘনফুট গ্যাস ২১০ টাকা করে কিনতে হচ্ছে, যেখানে বাপেক্স একই পরিমাণ গ্যাস ২৫ টাকা খরচ করে উৎপাদন করে। কস্ট রিকভারি ও প্রফিট গ্যাস বাবদ বহুজাতিক কোম্পানিগুলো যে পরিমাণ গ্যাস পায়, তা এভাবে উচ্চমূল্যে বাংলাদেশের কাছে বিক্রি করে বিপুল মুনাফা অর্জন করে। যেমন বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রে এযাবৎ বহুজাতিক শেভরনের বিনিয়োগ ২৭ কোটি ডলার এবং ২০০৬-০৭ থেকে এ বছরের এপ্রিল পর্যন্ত কস্ট রিকভারি ও প্রফিট গ্যাস বাংলাদেশের কাছে বিক্রি বাবদ আয় ১০৫.১৬ কোটি ডলার। অর্থাৎ মাত্র ২৭ কোটি ডলার বিনিয়োগ করে মাত্র কয়েক বছরে শেভরনের লাভের পরিমাণ ৭৮.১৬ কোটি ডলার। শেভরনের যেটা লাভ, বাংলাদেশের সেটা লস। বাংলাদেশকে নিজের গ্যাস শেভরনের কাছ থেকে প্রতিহাজার ঘনফুটে ২১০ — ২৫ = ১৮৫ টাকা বাড়তি মূল্যে, বলা যায়, বহুজাতিককে ভর্তুকি দিয়ে কিনতে হচ্ছে। এভাবে স্থলভাগে উৎপাদিত গ্যাস বিদেশী কোম্পানির কাছ থেকে কিনতে গিয়ে বাংলাদেশকে প্রতিবছর দুই থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে, সাগরের গ্যাস কোনকোফিলিপসকে দিয়ে তুললে যার পরিমাণ আরো বাড়বে।

জাতীয় সক্ষমতা
বহুজাতিক কোম্পানিকে এভাবে হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়ার টাকার অভাব না হলেও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্সকে সময়মতো প্রতিবছর কয়েকশ কোটি টাকা দেয়ার মতো টাকা নাকি আমাদের নেই! প্রশ্ন উঠতে পারে, বাপেক্সকে সময়মতো অর্থ দিলেই কি বাপেক্স এই মুহূর্তে সাগরের গ্যাস তুলতে পারবে? স্থলভাগে বাপেক্সের যথেষ্ট সক্ষমতা থাকলেও গভীর সমুদ্রের জটিল প্রযুক্তি ও দক্ষতা কি বাপেক্সের আছে? ম. তামিম তার লেখায় তো বলেই বসেছেন: ‘সমুদ্রে অনুসন্ধানের টাকা, প্রযুক্তি, লোকবল কোনোটাই তাদের নেই এবং সেটা করতে যাওয়া বাংলাদেশের পক্ষে উড়োজাহাজ তৈরির চেষ্টা করার মতো হঠকারিতা হবে, যাতে বিনা কারণে অজস্র টাকা ও সময় ব্যায় হবে।’ এখানে খেয়াল রাখা দরকার, যারা তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে জাতীয় সক্ষমতা অর্জনের কথা বলছে, তারা কিন্তু এর জন্য প্রয়োজনীয় সেমিসাবমারজিবল রিগ, সাপোর্ট ভ্যাসেল ইত্যাদি বাংলাদেশে তৈরির কথা বলছে না; বলছে, এগুলো ভাড়া করে/কিনে তেল-গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান ও উত্তোলনে ব্যাবহারের কথা। তাহলে উড়োজাহাজ তৈরির উদাহরণটা আসছে কেন? তুলনা করতে গেলে তো উড়োজাহাজ চালনা করার উদাহরণটা দেয়া দরকার। উড়োজাহাজ চালনার মতো জটিল কাজও তো বাংলাদেশের পাইলটদের শিখতে হয়েছে, তাহলে সেমিসাবমারজিবল রিগ কিংবা সাপোর্ট ভ্যাসেল ভাড়া করে এনে সেগুলো কন্ট্রাক্টরের মাধ্যমে পরিচালনা করাটা অসম্ভব কিংবা হঠকারিতা হতে যাবে কেন? বহুজাতিক কোম্পানিগুলো কি তেল-গ্যাস উত্তোলনে ব্যবহৃত সেমিসাবমারজিবল রিগ, সাপোর্ট ভ্যাসেল ইত্যাদি নিজেরা বানায় বা নিজেরা চালায়? ম. তামিমের তো অজানা থাকার কথা নয়, আশির দশকের সময় থেকেই কোম্পানিগুলো তাদের নিজেদের অনেক কাজ আউটসোর্সিং করতে শুরু করেছে। টেকনোলজি ডেভেলপ করার বদলে টেকনোলজি বিভিন্ন সার্ভিস কোম্পানি, যেমন Schlumberger, Halliburton, Baker Hughes, Oceaneering, Transocean ইত্যাদির কাছ থেকে সুবিধামতো ভাড়া করে তেল-গ্যাস উত্তোলনের কাজটি চালাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ বিপি’র কথা বলা যায়।

বিপি মেক্সিকো উপসাগরের যে মাকান্দো কূপে দুর্ঘটনায় ঘটিয়েছে, সে কূপে কাজ করছিল মূলত ট্রান্সওশান, হেলিবার্টন, স্লামবার্জার ইত্যাদি কোম্পানির যন্ত্রপাতি ও সার্ভিস ভাড়া নিয়ে। ডিপ ওয়াটার হরাইজন নামের সেমিসাবমারজিবল রিগটি বিপি ভাড়া নিয়েছে ট্রান্সওশানের কাছ থেকে। এই রিগটি থেকে ড্রিলিংয়ের কাজটি ট্রান্সওশানের কর্মীরাই করছিল, কূপ সিমেন্টিংয়ের কাজটি করছিল হেলিবার্টন এবং সিমেন্টিংয়ের পর তার কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্য ভাড়া করা হয়েছিল স্লামবার্জার কোম্পানিটিকে; বিপির কাজ ছিল কেবল এদের কাজ ঠিকঠাকমতো হচ্ছে কি না সেটা তদারকি করা। কাজেই স্থলভাগে গ্যাস উত্তোলনের দক্ষতাকে ব্যাবহার করে গভীর সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন বিষয়ে যথাযথ ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে বাপেক্সের পক্ষে এই ধরনের তদারকির কাজ করাটা অসম্ভব কোনো বিষয় নয়।

হাজার হাজার বছর ধরে আমরা দেখছি, জ্ঞান ও দক্ষতা যাদের কাছে, ক্ষমতাও তাদের হাতেই থেকে গেছে। পৃথিবীর কোনো জ্ঞান ও দক্ষতা একদিনে গড়ে ওঠে না। একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে জ্ঞান ও দক্ষতা বিকশিত হয়, পূর্ণতা পায় এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মধ্যে দিয়ে সেই জ্ঞান জনমুখী হওয়ার সক্ষমতা অর্জন করে। কিন্তু যেই দেশে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য প্রচার করে জাতীয় সক্ষমতা অর্জনের পথে বাধা তৈরি করা হয় সেই দেশের ক্ষমতাবানেরা যতই জ্ঞান চর্চা ও বিকাশের পক্ষে অবস্থান নেয়ার দাবি করুক না কেন তরুণরা কি আস্থা রাখতে পারে তাদের পরিবর্তনের অঙ্গীকারের ওপর?

তরুণদের ওপর অনাস্থা রেখে, তরুণদের নতুন চিন্তাধারা ও দেশগঠনের আগ্রহকে ধুলায় মিশিয়ে দিয়ে, হীনমন্যতা ও মানসিক দৈন্যে ভরা জনমত তৈরি করে, কীভাবে জ্ঞান-সমাজ তৈরি হবে? এদেশের তরুণরা কি বুঝতে পারছে যে, এই চুক্তি তাদের নিজেদের সক্ষমতা তৈরির পথেই অন্তরায়?

(লেখাটি তৈরি করতে কল্লোল মোস্তফার সহায়তা নেয়া হয়েছে ।)

তথ্যসূত্র:
১. মডেল পিএসসি ২০০৮।
২. বাপেক্স ওয়েবসাইট, এমআইএস রিপোর্ট।
৩. ডেইলি স্টার একুশ জুন, ২০১১।
৪. জাতীয় সম্পদ, বহুজাতিক পুজি ও মালিকানার তর্ক, কল্লোল মোস্তফা, অনুপম সৈকত শান্ত ও মাহবুব রুবাইয়াত।
৫. নাইল্যাকাডা, ছোট কাগজ, সম্পাদক: কল্লোল মোস্তফা

[মোশাহিদা সুলতানা ঋতু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাউন্টিং এন্ড ইনফরমেসন সিস্টেমস ডিপার্টমেন্ট এর অর্থনীতির প্রভাষক | ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও উনি এর আগে পড়িয়েছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে| তিনি ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেছেন এবং পড়াশুনা করেছেন তুরস্কে ও যুক্তরাষ্ট্রে| ২০০০ সনে তুরস্কের মিডেল ইস্ট টেকনিকাল ইউনিভার্সিটি থেকে অর্থনীতিতে অনার্স ডিগ্রী লাভ করার পর অর্থনীতিতে মাস্টার্স করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের নর্থইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি থেকে | পরবর্তীতে লেখক ম্যাসাচুসেট্স ইন্সটিউট অফ টেকনোলজি থেকে ইন্টারন্যাসনাল ডেভেলপমেন্ট এ দ্বিতীয় মাস্টার্স ডিগ্রী লাভ করেন | দীর্ঘ দশ বছর দেশের বাইরে পড়াশুনা শেষ করে  শিক্ষকতা পেশায় আছেন ২০০৬ সন থেকে| রাজনৈতিক অর্থনীতি, সেবাখাত বেসরকারিকরণ, শ্রমিক অধিকার, ও মাইগ্রেসন নিয়ে লেখকের গবেষণা কর্ম প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন সোসাল সাইন্স ও বিজনেস জার্নালে | শিক্ষকতা ও গবেষণার পাশাপাশি বিভিন্ন সাংগঠনিক কাজের সাথে তিনি যুক্ত আছেন| জাগরী নামে একটি স্বেচ্ছাব্রতী তরুণ সমাজের সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য| তিনি ন্যাশনাল এনার্জি এন্ড ওয়াটার কনজুমার ফোরামেরও প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও সম্পাদক|]

 

মূল লিংকঃ http://bit.ly/o6bvmX