ক
“ধুরো ভাই, এগুলো ভেবে কি কোন লাভ হবে?”
“তাতে আমার কিছু যায় আসে না, আমি তো ভালই আছি! খাচ্ছি-দাচ্ছি, ঘুমাচ্ছি, মুভি দেখতেসি, গেম খেলতেসি!”
“এদেশের কোন ভবিষ্যত নাই, আমি বাইরে চলে যাব।“
হ্যাঁ, এ কথাগুলো আমাদের আশেপাশের কিছু মানুষের কথা। তবে বাস্তবে এই কথাগুলো আমাদের প্রজন্মের অধিকাংশ ছেলেমেয়েরা তাদের মনে ধারণ করে।
বিশ্বাস না হলে কথা বলেই দেখুন না আপনার পাশের মানুষটির সাথে! বেশি পেছনে যাবার দরকার নেই কিন্তু! জানতে চান সাম্প্রতিক সময়ে কনকো ফিলিপস এর সাথে বাংলাদেশের তেল-গ্যাস চুক্তি নিয়ে, ভিকারুন্নিসার আন্দোলনে সরকার এবং মিডিয়ার ভূমিকা নিয়ে তার ভাবনাগুলো। আমি কিন্তু মনে প্রাণে চাই আপনি হতাশ না হোন, বরং এই বিষয়গুলো নিয়ে একটা খোলামেলা আলোচনা হোক। এক কানে ঢুকিয়ে আরেক কান দিয়ে বের করে দেওয়ার মত, আড্ডা শেষেই ভুলে যাবার মত আলোচনা নয়, বরং এমন কিছু যা আপনাদের দুজনকেই তাড়িত করবে কিছু একটা করার, কোনভাবে এই দৃশ্যগুলো বদলে দেবার।
কিন্তু তা হয়ে ওঠে না সচারাচর! কারণ আমরা অনেক কিছুই জানিনা। জানলেও তা অনেক কম বা কানের এক দিক দিয়ে ঢুকাই আরেক দিক দিয়ে বের করে দেই! আর যতটুকুই বা জানি, তার অনেক খানিই থাকে হলুদ রঙ মাখানো।
সাধারণত দেশ বিদেশে ঘটে যাওয়া খবরাখবর আমরা পাই মিডিয়া থেকে। মিডিয়া মানে, সংবাদপত্র কিংবা দেশী চ্যানেলগুলোর খবর। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে আমার দুটো অভিজ্ঞতা বলি,
১. ক্যাম্পাসের এক বন্ধুর ফোনে হঠাৎ আরেক সিনিয়র ভাইয়ের ফোন-
“কিরে, তোরা রিইউনিয়ন কইরা ফালাস, আমাদের কোন খবরও দেস নাই!”
“কই না তো ভাই! কেন কি হইসে?!”
“মিয়া ভং ধর? পেপারে পড়লাম তোরা রিইউনিয়ন করসস!”
বাস্তব ঘটনা হোল, ক্যাম্পাসের একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের কোন এক প্রোগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে বের হয়ে যাওয়া কিছু সিনিয়র এমনিতেই এসে যোগ দিয়েছিলেন। আর পত্রিকার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি অনুষ্ঠানে উপস্থিত না থেকে ঘরে বসেই খবর লিখে পত্রিকায় পাঠিয়ে দেন। পরদিন পত্রিকায় ছাপা হয় ঐ সংগঠনটির রিইউনিয়ন এর খবর। আর তা দেখেই উক্ত বড় ভাইয়ের ফোন!
২. কিছুদিন আগে আমরা কিছু সাধারণ শিক্ষার্থী মিলে তেল-গ্যাস চুক্তি সাক্ষরের প্রতিবাদে ক্যাম্পাসে একটি প্রতিবাদ কর্মসূচীর আয়োজন করি। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকরাও যোগদান করে। কর্মসূচীতে ছিল কার্টুন প্রদর্শনী, সংগীত পরিবেশন, পুথি পাঠ এবং মুক্ত আলোচনা। সন্ধ্যায় কর্মসূচীর সমাপ্তি ঘোষণা করে আমরা সবাই বাড়ি ফিরে যাই। পরদিন একটি বহূল প্রচারিত ইংরেজি দৈনিক আমাদের কর্মসূচীর খবর বেশ গুরুত্ব সহকারে ছাপে। তাতে আমাদের কর্মসূচীর বেশ ভাল বিবরণ থাকলেও রিপোর্ট এর শেষ লাইনে বলা হয় আমরা সমাবেশ শেষে একটি র্যালীর আয়োজন করি! অথচ আমরা কেউ তখন মনে করতে পারলাম না সমাবেশ শেষে সেই সন্ধ্যাবেলা আমরা কখন আবার র্যালী করলাম!
হ্যাঁ, এটাই আমাদের মিডিয়া। খবর বানানো, সত্যকে চেপে যাওয়া, আংশিক সত্য প্রকাশ এগুলো নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। আর আমরা যারা ঘটনাস্থলে থাকিনা, যাদের খবর জানার একমাত্র উপায় এই মিডিয়া তারা কি সরল মনেই না এসব বিশ্বাস করি!
অতি সম্প্রতি ভিকারুন্নেসানুন স্কুল এন্ড কলেজে যৌন নির্যাতনের দায়ে অভিযুক্ত শিক্ষকের বিচার ও অপরাধীকে সহায়তার অভিযোগে অধ্যক্ষের অপসারণের দাবিতে সংগঠিত আন্দোলনের ঘটনায় অন্য অনেক কিছুর সাথে দেশের কিছু প্রথম সারীর মিডিয়ার প্রশ্নবিদ্ধ আচরণ অনেকেরই চোখ থেকে একটি পর্দা সরিয়ে দিয়েছে। এসব মিডিয়ার সুশীলতা আর ভদ্রতার মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা হলুদ প্রাণীটি বের হয়ে এসেছে। আন্দোলনকারীদের অভিযোগ, মিডিয়া তাদের চূড়ান্ত অসহযোগিতা করেছে, কাজ করেছে একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর পক্ষে, আন্দোলনের খবর প্রকাশ করেনি। আর করলেও খবর বদলে দিয়েছে। ঐ স্কুল-কলেজের ছোট ছোট বাচ্চা থেকে শুরু করে সাবেক ছাত্রীরা যখন শুধুমাত্র তাদের বোনের জন্য বিচার চাইতে আর এক অসৎ ও অপরাধীকে সহায়তা দানকারী অধ্যক্ষকে অপসারণের জন্য আন্দোলনে নামতে বাধ্য হয়েছে তখন মিডিয়া এই আন্দোলনকে দিয়েছে রাজনৈতিক রঙ। বলেছে, অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করতে কোন তৃতীয় পক্ষের ইন্ধনে নাকি কতিপয় ছাত্রী আন্দোলন করছে। আর ঘটনাস্থলে মিডিয়া কর্মীরা কি করেছে তা জানতে চান? পড়ুন,
এক সাংবাদিক বললেন, “আপনারা ক্লাস বর্জন করলেন কেনো?”
জবাবে এক ছাত্রী বললেন “আপনার বোন রেইপড হলে আপনি কি করতেন?”
সাংবাদিকঃ দিস ইজ নান অব মাই বিজনেস। আমি হলে ক্লাস করতাম।
ছাত্রীঃ আপনারা আছেন আমাদের বারবার একই প্রশ্ন করছেন। আমাদের অবস্থা বুঝছেন না। সকাল থেকেই তো নিউজ নিচ্ছেন। কই? পাবলিশ তো করছেন দায়সারাভাবে।
সাংবাদিকঃ তো! আমি কি করতে পারি?
ছাত্রীঃ তো! পাবলিশ হচ্ছে না কেনো? টাকা খেয়েছেন? নাকি উপরের চাপ?
এই কথা শোনার পর রাগ করে বেরিয়ে গেলেন এনটিভি আর দেশটিভির সাংবাদিকরা। যাবার আগে জানিয়ে গেলেন, “এখন দেখবা তোমাদের নিউজ কিভাবে যায়। তোমাদের সাহস কমানোর সময় এসেছে।”
না এই খবর কোন পত্রিকায়, কোন মিডিয়ায় আসেনি। এ খবর সেদিন এক ব্লগার তার আন্দোলনকারী কিছু পরিচিতজনদের সহায়তায় ব্লগে পোষ্ট করেছিল। এভাবেই সেদিন আন্দোলনের সব সত্যি এবং মিডিয়ার চেপে যাওয়া খবরগুলো সবার কাছে পৌঁছে যেতে থাকে ব্লগ, ফেসবুক কিংবা টুইটারের মাধ্যমে!
কিছুদিন আগে এক বন্ধুর সাথে আলাপকালে সে বলছিল বাংলাদেশের ভবিষ্যত অন্ধকার। যেমন চলছে তেমনি চলবে কিংবা অবস্থা আরও খারাপও হতে পারে! আমি তাকে বলেছিলাম হতাশ না হতে। বাংলাদেশের আজকের প্রজন্ম আর তার আগের প্রজন্মগুলোর সাথে তফাত অনেকটা! আগে সবার তথ্য জানার একমাত্র মাধ্যম ছিল খবরের কাগজ, টেলিভিশন সংবাদ। একজন আরেকজনের সাথে যোগাযোগের মাধ্যম ছিল ফোন কিংবা চিঠি। এখন ছেলেমেয়েরা কিন্তু আর খবরের কাগজ কিংবা, টিভির সংবাদের ওপর নির্ভর করেনা! তারা ব্লগ পড়ছে, ইউটিউব দেখছে, সত্য জানছে। ফেসবুক/টুইটারের মাধ্যমে দেশের এক প্রান্তের সাথে আরেক প্রান্ত এমনকি বিদেশের সাথেও যুক্ত হয়ে যাচ্ছে। যে কোন তথ্য মূহুর্তে মাঝে শেয়ার-রিশেয়ার কিংবা টুইট-রিটুইট হয়ে যাচ্ছে। ছড়িয়ে যাচ্ছে তথ্য, ছড়িয়ে যাচ্ছে সত্য। কে থামাবে পারবে এই তথ্য স্রোত?
খ
যারা আমাদের ক্ষতি করতে চায় তারা আমাদের জানতে দিতে চায় না আমাদের ক্ষতির কথা। কারণ, মানুষ যখন জানতে পারে তার ক্ষতি হচ্ছে তখন সে ঠিকই রুখে দাঁড়ায়। নিজের ভাল পাগলেও বোঝে! তাই সবসময় চেষ্টা থাকে যে কোন ভাবে সত্যকে চাপা দিতে, মিডিয়ার সংবাদকে নিয়ন্ত্রণ বা প্রভাবিত করতে, যারা মানুষজনকে সত্যটা জানাতে পারবে তাদের কন্ঠ রোধ করতে। কিন্তু এই পরিবর্তিত প্রজন্মকে কিভাবে আটকে রাখবে এই অবিরাম তথ্য স্রোত থেকে?
গ
যে সাধারণ মেয়েটি সন্ধ্যার পর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত হিন্দি সিরিয়াল দেখত সে একদিন ঘটনাক্রমে দেখল তার বন্ধুর ফেসবুকে শেয়ার করা কিছু লিংক। পেল কিছু টুকরো খবর।
মার্কিন প্রতিষ্ঠান কনকো ফিলিপস এর সাথে গভীর সমুদ্রের সম্ভাবনাময় গ্যাস ব্লকে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের জন্য চুক্তি করেছে সরকার। চুক্তি অনুযায়ী কনকো ফিলিপস বিনিয়োগ করবে ৭০০ কোটি টাকা। আর এই বিনিয়োগের বিনিময়ে তারা পাবে প্রাথমিকভাবে মোট গ্যাসের ৫৫% ই, এর নাম ‘কষ্ট রিকভারী’ গ্যাস। অবশিষ্ট ৪৫% ‘লাভের গ্যাস’ ভাগাভাগি হবে বাংলাদেশ ও কনকো ফিলিপস এর মধ্যে। উত্তোলিত গ্যাসের পরিমাণভেদে এই ৪৫% এর ৫৫% থেকে ৮০% পাবে বাংলাদেশ। এখন লাভের গ্যাসের ৫৫% পাওয়ার মানে হলো মোট গ্যাসের ২৪.৭৫% পাওয়া, আর লাভের গ্যাসের ৮০% পাওয়া মানে মোট গ্যাসের ৩৬% পাওয়া। অথচ বলা হচ্ছে গ্যাসের ৮০% ই বাংলাদেশ পাবে। কষ্ট রিকভারী হিসেবে আগেই নিয়ে নেওয়া ৫৫% এর কথা চেপে যাওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের জ্বালানী খাত নিয়ে এত গুরুত্বপূর্ণ একটি চুক্তি নাকি গোপন রাখা হয়েছে দেশেরেই জনগণের কাছে। যেখানে আমাদের সংবিধান বলছে, এই গ্যাসের মালিক তো এ দেশের প্রতিটি মানুষ! মেয়েটি ভাবল, আমাদের কাছে চুক্তিটি গোপন করে, আমাদের মতামতের তোয়াক্কা না করে সরকার কিভাবে চুক্তিটি করতে পারল? সে দেখল, চুক্তিটি হয়েছে পি.এস.সি ২০০৮ এর মডেল অনুসারে। গুগলে সার্চ করে নামিয়ে নিল পিএসসি মডেলের পিডিএফ। সেদিন মেয়েটিকে আর টিভির সামনে দেখা যায়নি। মেয়েটি বসে বসে পিএসসি মডেলের ফাঁকফোঁকর গুলো বের করছিল। করছিল কিছু সাধারণ হিসাব নিকাশ। মেয়েটি দেখল, পিএসসি মডেলের ১৫.৫.৪ ধারায় স্পষ্ট বলা আছে, ১০ বছরের আগে কোনোভাবেই বাংলাদেশ সর্বমোট বিপণনযোগ্য গ্যাসের (লাভের গ্যাসের) ২০% -এর বেশি রাখতে পারবে না। ১o বছর পর চাইলে সর্বোচ্চ ৩০% পর্যন্ত রাখতে পারে। মেয়েটি মাথায় বিদ্যুত খেলে গেল। তার মুখ থেকে অস্ফূটে বেরিয়ে এলে, আমরা ঠকছি!
মেয়েটি পরদিন খবরের কাগজে এক বিশেষজ্ঞের কলামে দেখল, আমাদের দেশের এই বিপুল পরিমাণ ক্ষতি সত্ত্বেও বাইরের কোম্পানীর সাথে চুক্তি করার কারণ আমরা নাকি সক্ষম নই সমুদ্রবক্ষে গ্যাস অনুসন্ধান আর উত্তোলনে। সে সেদিন আবারও সিরিয়াল দেখা বাদ দিয়ে ইন্টারনেটে বসল। আমাদের দেশেও তো কিছু প্রতিষ্ঠান আছে যারা খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান আর উত্তোলন নিয়ে কাজ করে যেমন, বাপেক্স, বিজিএফসিএল। মেয়েটি বাপেক্স আর বিজিএফসিএল নিয়ে খোজ করা শুরু করল বিভিন্ন ওয়েব সাইট এ।
সে দেখল বাপেক্স গঠনের পর থেকে ১৯৮৯ পরবর্তী সময়ে বিদেশী কোম্পানিগুলো ১৭ টা অনুসন্ধান কূপ খনন করে, বেশ কিছু গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কার করে (যেগুলোর সাম্ভাব্যতা আগেই পেট্রোবাংলা/বাপেক্স বের করেছিল), দুটো গ্যাসক্ষেত্র ধ্বংস করে ফেলে আর এর বিপরীতে বাপেক্সকে দেয়া হয় মাত্র হাতে গোনা কয়টি ক্ষেত্র, তার মধ্যেও বাপেক্স সালদানদী, শাহবাজপুর ও শ্রীকাইলে গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে। অনুসন্ধান কুপ খনন করে ৪ টি, যার ৩ টিতেই গ্যাস মিলে। অর্থাৎ সাফল্যের হার ১.৩৩:১! বাপেক্স নাইকোর একটা কুপ (ফেনী-২) খনন করে দেয়, টাল্লোর হয়ে লালমাই ও বাঙ্গোরায় Well Cellar Survey’র কাজ করে, চাঁদপুরে কন্ট্রোল পয়েন্ট স্থাপন করে দেয়। বাঙ্গোরায় টাল্লোর একটা কুপও (ওয়ার্ক ওভার) খনন করে দেয়। এমনকি পেট্রোবাংলার আরেক সেলফ ফাইনান্সিং গ্যাস উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বিজিএফসিএল এর হবিগঞ্জ-৯ কুপ খনন করে দিলেও ঐ কুপ খননের জন্য বাপেক্সকে সরকারের বরাদ্দের দিকে থাকতে হয় দীর্ঘ প্রতীক্ষায়!
মেয়েটি আরও দেখল, রাস্ট্রায়ত প্রতিষ্ঠানগুলো এ পর্যন্ত ১৮ টি অনুসন্ধান কুপ খনন করে ৮ টি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করেছে। সাফল্যের হার ২.২৫:১, যা বাংলাদেশ কর্মরত বিদেশী কোম্পানীর সাফল্যের হারের চেয়ে ভালো। পেট্রোবাংলা নিয়মিতভাবে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে অর্থ যোগান দিয়ে যাচ্ছে। যেখানে ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরে এর পরিমাণ ১২০০ কোটি টাকা, সেখানে ২০০৭-২০০৮ অর্থবছরে এর পরিমাণ ৩১৫০ কোটি টাকা এবং ২০০৮-২০০৯ অর্থবছরে এর পরিমাণ ৩৩৪৯ কোটি টাকা, যার মধ্যে বাপেক্স দিয়েছে ৮২ কোটি টাকা, সবচেয়ে বেশী দিয়েছে বিজিএফসিএল – ১৪৩১ কোটি টাকা! পেট্রোবাংলার গ্যাস উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সরকারকে প্রতি হাজার কিউবিক ফুট গ্যাস মাত্র ২৫ টাকায় দিতে পারে (মুনাফা রেখেই), যেখানে বিদেশী কোম্পানির কাছ থেকে কিনতে খরচ হয় ২৫০ টাকা! এই চরম দূর্দশার মধ্যেও দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্জিত সাফল্যে মেয়েটি গর্ববোধ করে।
সম্প্রতি বাপেক্স কর্তৃক সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলা দুটির সীমানা ছাপিয়ে মাটির নিচে বিরাট গ্যাসগ্যাক্ষেত্র ‘সুনেত্রা’ আবিষ্কার হয়। এর অর্ধেকটাই ব্লক ১২-এর অন্তর্ভুক্ত, যা অতীতে বিদেশি কোম্পানির হাতে থাকাকালীন তারা এটি শনাক্ত করতে পারেনি; পরবর্তীকালে বাপেক্স তার সাইসমিক জরিপের মাধ্যমে এটি ম্যাপ করে। এই খবর পড়ার সাথে সাথে মেয়েটি এদেশের সম্ভাবনাকে চোখ বন্ধ করে দেখতে পেল আর সবিস্ময়ে লক্ষ্য করল তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে আনন্দের অশ্রুতে।
মেয়েটি হঠাত সম্বিত ফিরে পেল। চোখ মুছে সে গুগলে খুজতে থাকল বিদেশী কোম্পানিগুলো কিভাবে গ্যাস উত্তোলন আর অনুসন্ধানের কাজ করে। জানতে পারল, কোম্পানিগুলো তাদের নিজেদের অনেক কাজই আউটসোর্সিং করে। নিজেরা পুরো কাজ না করে বিভিন্ন সাবকন্ট্রান্ট এর মাধ্যমে অন্য কোম্পানি দিয়ে কাজ করিয়ে নেয়। কিছুদিন আগে বিপি মেক্সিকো উপসাগরের যে মাকান্দো কূপে দুর্ঘটনায় ঘটিয়েছে, সে কূপে কাজ করছিল মূলত ট্রান্সওশান, হেলিবার্টন, স্লামবার্জার ইত্যাদি কোম্পানির যন্ত্রপাতি ও সার্ভিস ভাড়া নিয়ে। মেয়েটি ভাবল, স্থলভাগে আমাদর গ্যাস উত্তোলনের দক্ষতাকে ব্যবহার করে বিভিন্ন আউটসোর্সিং এর মাধ্যমে আমাদের দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোও তো গভীর সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন করতে পারে। সেই উত্তোলিত গ্যাসের পুরোটাই তো তখন আমাদের থাকছে!
আমাদের দেশে বিদেশী কম্পানিগুলোর কাজের ইতিহাস সম্পর্কে খুজতে গিয়ে মেয়েটি জানতে পারল মাগুরছড়া আর টেংরাটিলার দূর্ঘটনার কথা, সেই দূর্ঘটনায় বিপুল পরিমাণ গ্যাস সম্পদ আর পরিবেশগত ক্ষতি হওয়ার পর ক্ষতিপূরণের হাত থেকে বাচতে এদেশের তৎকালীন জ্বালানী প্রতিমন্ত্রীকে নাইকোর দেওয়া ঘুষের ল্যান্ড ক্রুজার গাড়িটির কথা।
মেয়েটির কাছে তখন সবকিছু দিনের আলোর মতই পরিষ্কার হয়ে গেল। সে বুঝতে পারল, কেন বাপেক্স সত্যিকার অর্থে একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও সে এতদিন বাপেক্সকে অর্থব জানত। সে বুঝে যায়, কেন আমাদের আদমজী পাটকল বন্ধ হয়ে যায়, কেন বাংলাদেশের রেলওয়ের এত দূর্দশা, কেন আমাদেরই অবকাঠামো লিজ নিয়ে বিদেশী ফোন কম্পানিগুলো রমরমা ব্যবসা করে আর আমাদের টেলিটক পড়ে থাকে মূমুর্ষ অবস্থায়।
হ্যাঁ, ‘ওরা’ আমাদের মাথা উঁচু করে বাচতে দিতে চায় না। ‘ওরা’ চায়না আমরা আমাদের সম্ভাবনাগুলোকে পরিণত করি আমাদের শক্তিতে।
মেয়েটির হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে গেল অজান্তেই। কিছু একটা করতে হবে। হাত বাড়িয়ে মুঠোফোনটা নিয়ে ফোন দিল বন্ধুকে। বলল, “কথা আছে, দেখা কর, এখনি…কিছু একটা করতে হবে।“
মা নাস্তা খেয়ে বের হবার কথা বললেও সে একরকম ঝড়ের গতিতেই বের হয়ে গেল বাসা থেকে।
কে থামাবে আজ ওকে?